আমার নাম স্বপ্না। এটা আমার নিজের দেওয়া নাম। খুব অবাক হচ্ছেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি আপনাদের মতাে স্বাভাবিক কোনাে মানুষ নই। এই স্বপ্ন নামটা দিয়েছিলাম যখন আমার বয়স পনেরাে। এখন আমার বয়স তেত্রিশ। আমার বাবা-মায়ের রাখা নাম ছিল স্বপ্ন। আমি এর পাশে একটা আকার দিয়ে স্বপ্ন করেছি।
কাল সকাল দশটায় আমার জন্য অপেক্ষা করবে এই গােটা রসুলপুরের লােকজন। কাল আমার বিচার, গ্রাম্য শালিস। আমার বিরুদ্ধে নালিশটা বেশ গুরুতর। বাচ্চা চুরির অভিযােগ। গােটা রসুলপুরের মানুষের আরও কতশত অভিযােগ রয়েছে আমার উপর তার হিসাব আমার কাছেও নেই। শুনেছি কাল আমাকে জুতা পেটা করা হবে, আমার গলায় জুতার মালা পরিয়ে, নাকে খর দিয়ে এলাকা ছাড়া করবে। আচ্ছা আমি তাে এই এলাকা ছেড়েছি আরও আঠারাে বছর আগেই। কিন্তু এখনও আমাকে এই এলাকা নিজের করে রেখেছে এটা ভাবতেই বেশ অবাক লাগছে। আমি একজন মানুষ আপনাদের কাছে কি এই পরিচয়টা যথেষ্ট নয়? আমার কাছে এর থেকে ভালাে কোনাে পরিচয় যে নেই। যা আপনাদের দিতে পারব। তবে হ্যা, আপনার কাছে আমার অনেক পরিচয় রয়েছে; এই যেমন—হিজড়া,তৃতীয় লিঙ্গ, থার্ড জেন্ডার, কমন জেন্ডার, শিখণ্ডী ইত্যাদি।
আমার কত পরিচয় আছে আপনাদের কাছে। আমরা আপনাদের মতাে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারি না। আচ্ছা আমরাও তাে আপনাদের মতােই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের ঘর থেকেই এসেছি। আমার জন্মটা কি আমার অপরাধ? আমাকে সৃষ্টিকর্তা এভাবে বানিয়েছে এখানে আমার কি করার রয়েছে? আমার সৃষ্টি হওয়ার পিছনে আমার কি কোনাে অন্যায় ছিল, আমাকে জানাবেন দয়া করে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কেন আমি এমন হলাম, কেন আর দশটা সাধারণ মানুষের মতাে আমার জীবনটা হলাে না। যেখানে আমার সৃষ্টির পিছনে আমার কোনাে অপরাধ নেই, সেখানে আমার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শুধু আমার অন্যায় আর অন্যায়। ঘর থেকে বের হতে পারি না। আপনাদের মতাে সুস্থ মানুষগুলাের দ্বারা প্রতিনিয়তই আমরা হ্যারেসমেন্ট-এর স্বীকার হই। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারি না, কোনাে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে পারি না, এই দুনিয়াতে আমাদের জন্য কোনাে জায়গাই নেই। এই পৃথিবীতে আর একটা সম্প্রদায় কি আমাদের মতাে এতটা অবহেলিত কি না তা আমার জানা নেই।
“হিজড়া হয়ে জন্মানাে যদি আমার পাপ হয়ে থাকে, তাহলে সেই পাপে পাপী স্বয়ং ঈশ্বর।”
বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান আমি। খুব আদরে বড় হচ্ছিলাম কিন্তু বয়স বাড়ার । সাথে সাথে আমার সব আদরগুলােও ফ্যাকাশে হতে থাকে। শুনেছিলাম আমার জন্মদাতা পিতা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছিল বেশ কয়েকবার কিন্তু আমার মমতাময়ী মায়ের কল্যাণে বেঁচে গিয়েছিলাম প্রতিবারই। আজ প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার মায়ের উপর। আমার বাবা-মা আমাকে কোথাও নিয়ে যেত না। কত ইচ্ছে করত বাবার হাত ধরে একটু ঘুরতে কিন্তু তা কখনাে হয়নি। আমার ছােট একটা ভাই আছে, আমার থেকে আট বছরের ছােট। প্রতিবার আমার ভাইটার জন্মদিনে আমার বাবা-মা ঘটা করে আয়ােজন করত। কিন্তু আমার জন্মদিন বলে যে একটা দিন ছিল তা কখনােই আমার বাবা-মা স্মরণ করত না। এমনকি যখন আমাদের বাসায় কোনাে অনুষ্ঠান হতাে বা কোনাে আত্মীয় আমাদের বাসায় আসত। সেই অনুষ্ঠান কিংবা আত্মীয়টি না যাওয়া পর্যন্ত আমাকে টয়লেটে আটকে রাখা হতাে। জানেন জীবনের অনেকটা সময় আমাকে টয়লেটেই কাটাতে হয়েছে।
আরও পড়ুন,
গল্পটা মিথ্যে নয় - সকল পর্ব
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্নব - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
আমার ছেলেদের মতাে করে থাকতে ভালাে লাগত না। আমার মেয়েদের মতাে করে সাজতে ইচ্ছে করত। একবার আমি আমার মায়ের সমস্ত কসমেটিক্সগুলাে নিয়ে সুন্দর করে সেজেছিলাম। কিন্তু আমার বাবা আমাকে দেখে ফেলে। আমার বাবা তখন রাগ করে আমার তলপেটে একটা লাথি মারে।
শুধু কী তাই, কত যে নির্মম অত্যাচার চালাত আমার উপর তার হিসাব নেই। আমার গায়ে এই যে এতগুলাে দাগ এগুলাে আমার বাবার দেওয়া আশীর্বাদ। কত লােহা গরম করে আমার হাতে, পিঠে দাগ দিয়েছে তার কোনাে হিসাব নেই। এগুলাে আমাকে খুব একটা কষ্ট দিত না। আমার খুব ইচ্ছে করত আমার ছােট ভাইটাকে একটু আদর করতে। কিন্তু আমাকে কখনাে আমার ভাইকে স্পর্শ করতে দিত না।
Post a Comment