F স্টিফেন হকিং এর জন্ম ও শৈশব - তৃতীয় পর্ব

সারা তখন আমার অনেক কিছুর সাথী। সে ছিলাে আমার মায়ের সবচেয়ে বড় বােন জ্যানেট (Janet)-এর মেয়ে। তিনি ডাক্তারি পড়েছিলেন আর তার বিয়ে হয়েছিলাে একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট-এর সাথে। তারা পাঁচ মাইল উত্তরে হার্পেন্ডেন (Harpenden) গ্রামে একই রকম একটা বাড়িতে থাকতেন। আমাদের সেন্ট অ্যালবাম (St. Albans)-এ বাস করতে যাওয়ার সেটা ছিলাে একটা কারণ। সারার কাছে থাকা আমার কাছে ছিলাে একটা বিরাট লাভের ব্যাপার।

 

 


 

আমি প্রায়ই বাসে করে হার্পেন্ডেন্ যেতাম। সেন্ট অ্যালবাম ছিলাে প্রাচীন রােমান শহর ভেরুলামিয়ামের (Verulamiam) পর। ভেরুলামিয়া ছিলাে লন্ডনের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি রােমান জনপদ। এটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিলাে অনেক।          মধ্যযুগে ব্রিটেনের সবচেয়ে বিত্তশালী মঠ ছিলাে ওখানে। এটা তৈরি হয়েছিলাে সেন্ট অ্যালবান-এর মন্দিরের চারপাশে। তিনি ছিলেন প্রথম রােমান শতায়ু যাকে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসের জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলাে। মাঠের অবশিষ্ট ছিলাে কেবল একটা বিরাট এবং বিশ্রী গির্জা আর প্রাচীন মঠের প্রবেশদ্বারের দালানটি। সেটা তখন ছিলাে সেন্ট অ্যালবান্স স্কুলের একটি অংশ। পরে আমি সেই স্কুলেই পড়েছিলাম। এ স্কুলে আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে আছে।        

 

 

তবে তুলনামূলকভাবে হাইগেট কিংবা হার্পেন্ডেনের তুলনায় সেন্ট অ্যালবান্স ছিলাে একটু গোঁড়া আর ভারিক্কি জায়গা। আমার বাবা-মায়ের সেখানে কোনাে বন্ধু হয় নি। মূলত সেটা ছিলাে তাদের নিজেদের দোষ । কারণ তাদের স্বভাব ছিলাে একটু একা থাকা, বিশেষ করে এ রকম স্বভাব ছিলাে আমার বাবার। কিন্তু ওখানকার জনসাধারণের শ্রেণিগত পার্থক্যেরও এটা প্রকাশ ছিলাে। আমার সেন্ট অ্যালবান্স-এর স্কুলের বন্ধুদের কারােরই বাবা-মাকে বুদ্ধিজীবী বলা যেতাে না। তারা অনেকটা সাধারণ ও সহজ-সরল ছিলাে।          

 

 

 

এই হাইগেটে আমাদের পরিবারটা মােটামুটি স্বাভাবিকই ছিলাে। কিন্তু মনে হয় সেন্ট অ্যালবাস-এ আমাদের নিশ্চয়ই একটু ছিটগ্রস্ত (Eccentric) বলে ভাবা হতাে। আমার বাবার আচার-ব্যবহারে লােকের এ রকম মনে হতাে। টাকা বাঁচানাে সম্ভব হলে তিনি নিজের চেহারা কেমন হলাে তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। অল্প বয়সে তাদের পরিবার ছিলাে খুবই গরীব। তার মনে সে দারিদ্র একটা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিলাে। নিজের আরামের জন্যে পয়সা খরচ করা তিনি কখনাে একটুও সহ্য করতে পারতেন না। এমন কি শেষ বয়সে যখন পয়সা খরচ করবার মতাে অবস্থা হয়েছিলাে তখনাে না। তিনি ঠাণ্ডায় খুবই কষ্ট পেতেন। কিন্তু বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং লাগাতে রাজী হন নি। তার পরিবর্তে তিনি নিজের স্বাভাবিক পােশাকের উপর কয়েকটা সােয়েটার আর ড্রেসিংগাউন্ পরে বসে থাকতেন। কিন্তু পরের জন্যে তিনি যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতেন। তাতে তার কোনাে কৃপণতা ছিলাে না। এখানে তিনি ছিলেন উদার ।      চিত্র ২: এভাবেই চেয়ারে বসে সময় কাটে স্টিফেন ডব্লিউ. হকিংয়ের।        

 

 

 

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। বাবা ভাবলেন নতুন গাড়ি কেনার মতাে পয়সা তার নেই। সুতরাং তিনি যুদ্ধের আগেকার পুরানাে একটা লন্ডন ট্যাক্সি কিনলেন। আমি আর বাবা দু জনে মিলে একটা নিসেন হাট তৈরি করেছিলাম। সেটা ছিলাে গাড়ির গ্যারেজ । আমাদের পড়শিরা তাতে খুব রেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা আমাদের কাজ বন্ধ করতে পারেন নি। সব ছেলেদের মতােই আমি সবার সাথে মানিয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। আমার বাবা-মায়ের কাজ-কর্মে একটু লজ্জাও পেতাম। কিন্তু ওরা তা নিয়ে কোনাে মাথা ঘামাতেন না। আর তাই আমি আমার মতাে কাজ করে যেতাম।        

 

 

 

এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা যে, আমরা সেন্ট অ্যান্স-এ যখন প্রথম গেলাম তখন আমাকে মেয়েদের হাইস্কুলে ভর্তি করা হয়েছিলাে। স্কুলের নামটা ওরকম হলেও দশ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেরা ঐ স্কুলে পড়তে পারতাে। সেই স্কুলে এক টার্ম (বৎসরের একটা অংশ) পড়ার পরে কিন্তু আমার বাবা আফ্রিকায় গেলেন। আফ্রিকায় তিনি প্রতি বছরই যেতেন। তবে সে বছর তিনি একটু বেশি দিনের জন্যে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রায় চার মাসের জন্যে। বাবাকে ছেড়ে অতত দিন থাকা আমার মায়ের পছন্দ হয় নি। সুতরাং তিনি আমাকে এবং আমার দুই বােনকে নিয়ে তার স্কুলের বন্ধু বেরিল (Beryl)-এর কাছে চলে গেলেন।        

 

 

 

বেরিল্-এর বিয়ে হয়েছিলাে রবার্ট গ্রেঙ্গন (Robert Graves)-এর সাথে। তিনি থাকতেন স্পেনের মেজরকা (Mejorca) দ্বীপের দেয়া (Deya) গ্রামে। ব্যাপারটা ঘটেছিলাে যুদ্ধের মাত্র পাঁচ বছর পর। হিটলার-মুসােলিনীর বন্ধু স্পেনের ডিক্টেটর তখনাে ক্ষমতায় আসীন। (আসলে তিনি তারপরেও কুড়ি বছর ক্ষমতায় আসীন ছিলেন)। যুদ্ধের আগে আমার মা ইয়াং কমুনিস্ট লীগের সদস্য ছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি তিনটি তরুণ শিশুকে নিয়ে মেজরকা গেলেন।        

 

 

আমরা এই দেয়া-তে একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। সেখানে আমাদের দিনও কেটেছে অনেক আনন্দে। আমার এবং রবার্টের ছেলে উইলিয়ামের একই মাস্টার ছিলেন। এ মাস্টারমশাই ছিলেন রবার্টেরই একজন চেলা (Protege)। আমাদের পড়ানাের চেয়ে তার বেশি আকর্ষণ ছিলাে এডিনবরা উৎসবের জন্যে একটা নাটক লেখা। সুতরাং তিনি আমাদের প্রতিদিন বাইবেলের এক অধ্যায় করে পড়ে সে সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখতে বললেন। উদ্দেশ্য ছিলাে আমাদের ইংরেজি ভাষার সৌন্দর্য যাবতীয় শেখানাে ।        ওখান থেকে চলে আসার আগে আমরা বাইবেলের জেনেসিস্ (Genesis) এবং এক্সোডাস্ (Exodus) অধ্যায়ের একটা অংশ যথাযথভাবে সমাপ্ত করি। প্রধান যে কয়টা জিনিস আমি শিখেছিলাম তার ভেতর একটা ছিলাে ‘And’ দিয়ে কোনাে বাক্য শুরু না করা। আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, বাইবেলের প্রায় প্রতিটি বাক্যই ‘And’ দিয়ে শুরু হয়েছে। কিন্তু আমাকে বলা হলাে রাজা জেমস্ (King James)-এর পরে ইংরেজি ভাষার অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।        

 

 

 

আমি বললাম, তাহলে আমাদের বাইবেল পড়ালেন কেন? কিন্তু কোননা লাভ হয় নি। সে সময় রবার্ট গ্রেভস-এর বাইবেলের ভেতরকার অতীন্দ্রয়বাদ এবং প্রতীকীবাদ (Mysticism & Symbolism)-এ ছিলাে খুব উৎসাহ। তারপরের ঘটনা।        মেজরকা থেকে ফেরার পর আমাকে এক বছরের জন্যে অন্য একটা স্কুলে ভর্তি করা হয়। তারপর আমি তথাকথিত ইলেভেন্ প্লাস পরীক্ষা দিলাম। এটা ছিলাে একটা বুদ্ধির পরীক্ষা। যারা সরকারি শিক্ষা চাইতাে তাদের এ পরীক্ষা দিতে হতাে। এ পরীক্ষা এখন উঠে গেছে। তার প্রধান কারণ হলাে, অনেক মধ্যবিত্ত ছেলে-মেয়েরা এ পরীক্ষায়অকৃতকার্য হতাে এবং তাদের এমন স্কুলে পাঠানাে হতাে যেখানে খুব তাত্ত্বিক শিক্ষা হতাে (Non-academic School)। আমি স্কুলের ক্লাসের পড়ায় যতাে নম্বর পেতাম তার চেয়ে অনেক বেশি নম্বর পেতাম পরীক্ষায়। সুতরাং আমি ইলেভেন প্লাসের পরীক্ষায় পাশ করে সেন্ট অ্যাল্বান্স স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুবর্ণ সুযােগ পেলাম। এটি আমার জন্য ছিলাে একটি অনেক বড়াে পাওয়া ।        

 

 

 

আমার যখন ১৩ বছর বয়স তখন আমার বাবা চাইলেন যে আমি ওয়েস্ট মিনস্টার (West Minster) স্কুলে ভর্তি হই। সেটা ছিলাে একটা প্রধান পাবলিক স্কুল অর্থাৎ আসলে প্রাইভেট স্কুল। তখনকার দিনে শ্রেণির ভিত্তিতে শিক্ষার একটা কঠিন বিভাজন ছিলাে। আমার বাবার ধারণা ছিলাে যে, তার যােগাযােগ কম এবং গুরুত্বও কম। সে জন্যে তার চেয়ে অনেক কম দক্ষ লােকেরা তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার কারণ তাদের সামাজিক অবস্থান অনেক উঁচুতে।        

 

 

আমার বাবা-মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালাে ছিলাে না। সে জন্যে আমার দরকার ছিলাে স্কলারশিপ পাওয়া। স্কলারশিপ পরীক্ষার সময় কিন্তু আমি অসুস্থ ছিলাম। সে জন্যে পরীক্ষাটা আমার দেওয়া হয় নি। তার পরিবর্তে আমি সেন্ট অ্যালবাল স্কুলেই রয়ে গেলাম। সেখানে আমি যা শিক্ষা পেয়েছিলাম সে শিক্ষা ওয়েস্ট মিনস্টার স্কুলে আমি যে শিক্ষা পেতাম তার মতাে নিশ্চয়ই, হয়তাে বা তার চেয়েও অনেক ভালাে। আমার কখনাে মনে হয় নি উঁচু তলার সমাজের আদব-কায়দা জানা না থাকায় আমার বিশেষ কোনাে বাধা হয়েছে। আমি সেখানে সবার সাথে মিশতে ও চলতে পেরেছি।        

 

 

অবশ্য একথা সত্য যে, তখনকার দিনে ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা ছিলাে খুবই শ্রেণিভিত্তিক। শুধু স্কুলগুলােকেই উচ্চশিক্ষার (Academic) জন্যে এবং উচ্চশিক্ষার জন্যে নয় (Non-academic)-এ দু ভাগে ভাগ করা হয়েছিলাে তাই নয়, উচ্চশিক্ষার জন্যে যে স্কুলগুলাে, সেগুলােকেও ভাগ করা হয়েছিলাে A, B এবং C এ তিনটি স্রোতে (Stream)। যারা A স্ট্রীম-এ ছিলাে তাদের পক্ষে ব্যাপারটা ভালােই হতাে। কিন্তু যারা B স্ট্রীম-এ থাকতাে তাদের পক্ষে ব্যাপারটা ততাে ভালাে হতাে না। আর যারা C স্ট্রীম-এ থাকতাে তাদের পক্ষে ব্যাপারটা খারাপই হতাে। ফলে তারা নিরুৎসাহ হতাে।        

 

 আরও পড়ুন, গল্পটা মিথ্যে নয় - সকল পর্ব  সকল গল্প মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব  জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব একজন হকার - সকল পর্ব Fact Mohi আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব স্টিফেন হকিং - সকল পর্ব

 

ইলেভেন প্লাসের পরীক্ষার ভিত্তিতে আমাকে A স্ট্রীম-এ রাখা হয়েছিলাে। কিন্তু প্রথম বছরের পর যাদের স্থান বিশ জনের নিচে হতাে তাদের B স্ট্রীম-এ নামিয়ে দেওয়া হতাে। এটা ছিলাে তাদের আত্মসম্মানের পক্ষে একটা বিরাট আঘাত। ফলে অনেকেই সে আঘাত সামলে উঠতে পারতাে না। সেন্ট অ্যালবাগ-এ প্রথম দুই টার্মে আমি চব্বিশ আর তেইশতম স্থান পেয়েছিলাম। কিন্তু তৃতীয় টার্মে আমার স্থান হয়েছিলাে অষ্টাদশ। সুতরাং আমি কোনাে রকমে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্য আমার অবস্থা এতাে খারাপ হবে তা কখনাে ভাবি নি।        

 

 আরও পড়ুন,

 

আমি কখনােই ক্লাসে মাঝামাঝির উপরে উঠতে পারি নি (ক্লাসটা ছিলাে খুবই মেধাবী আর সম্ভাবনাময়)। আমার ক্লাসের কাজ-কর্ম ছিলাে খুবই অপরিচ্ছন্ন আর আমার হাতের লেখা ছিলাে শিক্ষকদের হতাশার কারণ। কিন্তু আমার ক্লাসের বন্ধুরা আমার নাম দিয়েছিলাে আইনস্টাইন। সে জন্যে মনে হয় আমার ভেতরে তারা ভালাে কোনাে লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলাে।

Post a Comment

Previous Post Next Post