F অসুস্থ বাংলাদেশ

আনিস সাহেব একজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পেশায় একজন উকিল। আসামিকে বেকসুর খালাস দিতে রাত-দিন পরিশ্রম করেন। আনিস সাহেবের বয়স একান্ন বছর, গায়ের রং কালাে, ছয় ফুট লম্বা এবং মুখে কালাে কালাে মেসতার দাগ রয়েছে। প্রচুর বই পড়েন। একটাও অদরকারী বই নয়, যে বইগুলাে পড়লে টাকা প্রসব হবে শুধু সেই বইগুলােই পড়েন। অর্থাৎ সব কয়টিই আইনের বই। আইনের মারপ্যাচ দিন দিন খুব ভালােই রপ্ত করেছেন আনিস সাহেব। এই তাে কিছুদিন আগে এক ধর্ষণকারীর হয়ে লড়েছেন। শুধু লড়েননি ধর্ষণকারীকে একজন ফেরেশতা হিসেবে প্রমাণ করে ছেড়েছেন। দিন দিন আনিস সাহেবের স্কিলগুলাে খুবই ধারালাে হচ্ছে। প্রতিবার একটা করে কেস জেতার পর সপ্তাখানেক তিনি রেস্টে থাকেন। পরিবারের সাথে সময় কাটান।


অসুস্থ-বাংলাদেশ,Fact-Mohi
অসুস্থ বাংলাদেশ 


আনিস সাহেবের দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দুটি আমেরিকায় থাকে আর মেয়েটি এবার বাংলাদেশের একটি নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। মানুষ হিসেবে আনিস সাহেব কেমন। তা নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে। অপরাধীর চোখে আনিস সাহেব একজন সাক্ষাৎ ভগবান। শুধু যে অপরাধীর হয়েই লড়ে তা কিন্তু নয়, তবে তার জীবনে যতগুলাে কেসে তিনি জয়লাভ করেছেন তার বেশিরভাগই অপরাধীর হয়ে। তাই অপরাধীর কাছে। আনিস সাহেব এখন একজন ব্রান্ড। আনিস সাহেবের স্ত্রী একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। মহল্লায় তার বেশ সুনাম রয়েছে। সব মিলিয়ে খুব উচ্চ-মর্যাদা নিয়েই সমাজে বসবাস করছেন আনিস সাহেব।




আনিস সাহেব বেশিরভাগ সময় তার অফিসে থাকেন অপর দিকে তার স্ত্রী থাকেন স্কুলে আর মেয়েটাও বেশিরভাগ সময় ইউনিভার্সিটিতেই কাটিয়ে দেয়। এত বড় বাড়ি বেশিরভাগ সময় খালিই পড়ে থাকে। একজন কাজের মহিলা রয়েছে সে সারাদিন কাজ করে ঘর মােছা থেকে শুরু করে কাপড় ধােয়া, রান্না করা সব তিনিই করে থাকেন। তার নাম মােছা. কুলসুম বেগম। বাড়ি ময়মনসিংহ। ঢাকায় একটা বস্তিতে স্বামী আর সন্তান নিয়ে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আনিস সাহেবের বাসায় কাজ করে। তবে লােকমুখে শােনা যায় আনিস সাহেবের বাসায় কোনাে বুয়া দুমাসের বেশি টিকতে পারেনি। এখন এর কারণ হিসেবে অনেকেই অনেক কথা বলে। কেউ কেউ বলে কাজের মহিলারা চুরি করে থাকে তাই আনিস সাহেব বুয়া পরিবর্তন করেন। আবার কেউ কেউ তাে আনিস সাহেবের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তােলে। তবে সবকিছুই আনিস সাহেবের পিছনের কথা। সামনাসামনি আনিস সাহেবকে কিছু বলার ক্ষমতা এখনও কারাে হয়নি। যায়হােক, কুলসুম বেগম কাজ নিয়েছে কেবল পনেরাে দিন হলাে। দেখা যাক সে কতদিন এই বাসায় কাজ করতে পারে।




আনিস সাহেবের বাসায় এখন পর্যন্ত যতগুলাে কাজের মহিলা এসেছে সবার চেহারা-সুরত নাকি মাস-আল্লাহ। যাদের চেহারা ভালাে নয় তারা কখনাে আনিস সাহেবের বাসায় কাজ করতে পারে না। আনিস সাহেবের বাসায় কাজ করতে হলে সবার আগে চেহারা ভালাে হতে হবে এবং বয়স যত কম হবে ততই ভালাে। কুলসুমের বয়স একত্রিশ, দেখতে সুন্দর আর কর্মঠ একজন মহিলা। কথাবার্তা, চালচলন বেশ মার্জিত। তাকে নিয়ে সবাই বেশ খুশি। আনিস সাহেবের বাসার দারােয়ান অনেক দেখেশুনে কুলসুমকে এ বাড়িতে নিয়ােগ দিয়েছে। একজন ভালাে সুন্দরী কাজের বুয়া নিয়ােগ দিতে পারলে আনিস সাহেব খুশি হয়ে এক হাজার টাকা বকশিশ দিয়ে থাকেন দারােয়ানকে। তাই প্রতি মাসেই বেশ বাড়তি কিছু ইনকামও হয়ে থাকে দারােয়ানের। তবে বিয়য়টি দারােয়ান এবং আনিস সাহেবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।




আজ শনিবার সরকারি ছুটির দিন। সাধারণত ছুটির এই দিনগুলােতে নাকি আনিস সাহেব সারাদিন বই পড়েই কাটিয়ে দেন। প্রতি সপ্তাহেই বেশ কিছু বই-এর অর্ডার দেয় অনলাইন শপ থেকে। ইদানীং এলাহী বিডি.কম আনিস সাহেবের কাছে বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। আনিস সাহেবের জটিল সব বইগুলাে সংগ্রহ করাটাই রীতিমতাে চ্যালেঞ্জের বিষয়। সেখানে অনলাইন এই শপটি প্রতিবারই আনিস সাহেবকে বইগুলাে দিয়ে থাকে। প্রতি শনিবারই তাই আনিস সাহেবের বাসায় ডেলিভারি ম্যান বই দিতে চলে আসে। তেমনি আজকেও এলাহী বিডির ডেলিভারি ম্যান বই দিতে আনিস সাহেবের বাসায় কলিং বেল টিপছে। প্রায় দশ মিনিট ধরে কলিং বেল বাজানাের পরও ভিতর থেকে কেউ দরজা খুলছে না। আনিস সাহেবকে ফোন দেওয়া হচ্ছে কিন্তু তিনি ফোনটাও ধরছেন না। প্রায় পনেরাে মিনিট পর আনিস সাহেব দরজাটি খুলল। বিধ্বস্ত অবস্থায় আনিস সাহেব বাসা থেকে বের হলেন। সারা শরীরে ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। কথাবার্তায় কেমন জানি অস্পষ্টের ছাপ। কথা আটকে আটকে যাচ্ছে।




ডেলিভারি ম্যান : স্যার আপনাকে দুটি বই দিতে পারিনি। পরের উইকে আমরা সেই দুটি বই দিয়ে যাব।


আনিস সাহেব : হুম।


ডেলিভারি ম্যান : স্যার আপনার আটশ বাইশ টাকা হয়েছে।




আনিস সাহেব এক হাজার টাকার একটা নােট বের করে ডেলিভারি ম্যানকে দিলেন। বাকি টাকা রেখে দিতে বললেন ডেলিভারি ম্যানকে। প্রায় চার মাস ধরে একই ডেলিভারি ম্যান প্রতি শনিবার আনিস সাহেবকে বই দিয়ে থাকে কিন্তু কখনােই একটি টাকা বেশি দেয়নি। আজ এমন কী হলাে যে এতগুলাে টাকা বকশিশ দিয়ে দিলেন। এর মধ্যেই ভিতর থেকে এক মহিলা দৌড় দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেল। মহিলাটির কাপড় ছেড়া আর শরীরের বিভিন্ন অংশ প্রায় ক্ষতবিক্ষত। ডেলিভারি ম্যান এবং আনিস সাহেব দুজনই দুজনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দুজনই যে যার মতাে চলে গেল।




সেদিন বিকেলে খবর এলাে আনিস সাহেবের বাসার কাজের বুয়া আত্মহত্যা করেছে। কুলসুম বেগম তার নিজ বাড়িতে সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে ফাসি নিয়েছে। ফাঁসি দেওয়ার কোনাে কারণ কেউ জানে না। কুলসুম বেগমের স্বামী একজন রিকশাচালক। অভাবের সংসার হলেও কোনােদিন তাদের সংসারে সুখের অভাব ছিল না। তাদের একটি ছেলে আবরার, এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। স্কুল থেকে ফিরে মায়ের দেহটা ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকতে দেখে ।




আত্মসম্মান বােধ থেকেই হয়তাে চলে গিয়েছে কুলসুম বেগম। পুলিশ কুলসুম বেগমের দেহটি পােস্টমর্টেমের জন্য পাঠালে বেরিয়ে আসে আগে ধর্ষণের স্বীকার হয়।




চাঞ্চল্যকর তথ্য। কুলসুম বেগম মারা যাওয়ার সেদিন ছিল শনিবার সরকারি ছুটির দিন থাকায় আনিস সাহেব বাসাতেই ছিলেন। আনিস সাহেবের মেয়ে প্রতিদিনকার মতােই ইউনিভার্সিটিতে চলে যায় আর তার স্ত্রী চলে যায় স্কুলে। সেই সুযােগেই আনিস সাহেব কুলসুম বেগমের উপর ঝাপিয়ে পড়েন এবং আনিস সাহেব দ্বারা ধর্ষণের স্বীকার হয় কুলসুম বেগম। পুলিশ সেদিন ঘটনা তদন্ত করতেই এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। ব্যাস আনিস সাহেবকে সােজা জেলখানায় নিয়ে গেল পুলিশ।




মজার ব্যাপার হলাে যিনি এই ধর্ষণটি করেছেন, তিনিই আবার নানা ধর্ষণকারীকেই বেকসুর মুক্তি দিয়ে ফেরেশতা বানিয়ে ছেড়েছেন। আজ নিজেই ফেঁসে গিয়েছেন ধর্ষণের জালে। এবার লড়বেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ধর্ষণ স্পেশালিস্ট আনিস সাহেব। আনিস সাহেব তার হয়ে একজন ভালাে আইনজীবী নিয়ােগ দিয়েছেন। সাথে আনিস সাহেব তাে রয়েছেনই। আনিস সাহেব কি পারবেন এবার নিজেকে বাঁচাতে?




দুমাস পর


আনিস সাহেব নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য যতগুলাে মাধ্যম রয়েছে। তার সবই করেছেন। ধর্ষণের এই খবরটি যে ভিত্তিহীন তা সবার চোখেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আনিস সাহেবের বিরুদ্ধে কেউ কোনাে সাক্ষী দেননি। এরই মধ্যে পােস্টমটার্মের রিপাের্টটিও ভুল প্রমাণিত করেছেন। আনিস সাহেবের সম্মান নিয়ে যারা খেলেছেন উলটো তাদের বিরুদ্ধে এবার মানহানির মামলা করার সীদ্ধান্ত নিয়েছেন আনিস সাহেব।




আজ আনিস সাহেবকে বেকসুর খালাস দিয়ে তাকে আবার তার প্রফেসনে ফিরেয়ে দেবে আদালত। আনিস সাহেবের মতাে সম্মানীয় ব্যক্তিকে হ্যারেসম্যান্ট করার জন্য লজ্জিত আদালত এবং পুলিশ। ঠিক তখনি আদালতে হাজির এলাহী বিডির সেই ডেলিভারি ম্যান। সে জানাল তার কিছু বলার রয়েছে। তাকে অনুমতি দেওয়া হলাে।





ডেলিভারি ম্যান বলতে লাগল স্যার আমার নাম মাে, জারিফ। আমি এলাহী বিডির ডেলিভারি ম্যান। প্রতি শনিবারই আমি আনিস সাহেবের জন্য বই নিয়ে তার বাসায় যেতাম। তেমনি এক শনিবারেও আমি বই নিয়ে তার বাসায় যাই। প্রায় পনেরাে মিনিট সেদিন তার বাসার কলিং বেল বাজালেও তিনি সেদিন দরজা খুলছিলেন না। অনেকটা সময় পর তিনি যখন দরজা খুললেন তখন তার অবস্থা প্রায় বিধ্বস্ত। শরীরে প্রচুর ঘাম এবং কথাবার্তায় অস্পষ্ট ভাব ছিল। যখন কোনাে অপরাধী অপরাধ করে এবং ধরা খাওয়ার আশঙ্কা থাকে তখন যে আচরণগুলাে করে থাকে তার সবটাই সেদিন তিনি করেছিলেন।



আনিস সাহেবের আইনজীবী বলতে লাগল স্যার এই ডেলিভারি ম্যান তাে দেখছি একজন ফিলােসপি স্পেশালিস্ট। সে চেহারা আর কথা বলা দেখেই বলে দিতে পারে কে অপরাধ করেছে আর কে করেনি। আদালতের সবাই তখন অট্টহাসিতে ব্যস্ত।




আইনজীবী : আচ্ছা ডেলিভারি ম্যান মিস্টার জারিফ সাহেব আপনি কি দেখেছেন ধর্ষণটি আনিস সাহেবই করেছে? না আমি দেখিনি। তাহলে আপনি কী করে বুঝলেন যে ধর্ষণটি আনিস সাহেবেই করেছে?




জারিফ : স্যার আমি সেদিন টাকা নিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই কুলসুম বেগম আনিস সাহেবের ঘর থেকে দৌড় দিয়ে বের হয়েছিল। তখন কুলসুম বেগমের শাড়ির অনেক অংশ ভেঁড়া ছিল এবং শরীরেও নানা জায়গায় জখমের দাগ স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছিল।




এবার জজ সাহেব বলে উঠলেন, মি. জারিফ সাহেব এই কেসটার এত দিন হয়ে গেল আপনি মুখ খুললেন না কেন এতদিন। জবাবে জারিফ বলল স্যার, খুলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। সেদিনের সেই ঘটনা বলতে আমি । পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। বলেও ছিলাম কিন্তু উলটো আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার কথা বলে আমাকে ভয় দেখিয়েছিল। তাছাড়াও আমি অনেকের কাছেই বিষয়টি শেয়ার করেছি কেউ আর সাহস করে আনিস সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চায়নি। তাও ভালাে সবাইকে শুধু আমি আমার মুখের কথাই বলেছিলাম। আসল জিনিসটা আমি কাউকেই দেখায়নি। আইনজীবী এবার রেগে গিয়ে বলল, আসল জিনিস মানে?


জারিফ এবার বলতে লাগল। স্যার আমি সেদিন কুলসুম বেগমকে এই অবস্থায় দেখে আমার সন্দেহ হয়। সেদিন আমি আর কারাে পার্সেল ডেলিভারি করিনি। পিছু নিয়েছিলাম কুলসুম বেগমের। এক পর্যায়ে তার বাড়িতেও চলে যাই। কুলসুম বেগমকে সবকিছু খুলে বলতে বললাম । কিন্তু সে মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছিল সেদিন। সে কোনােভাবেই মুখ বুলতে রাজি নয় । আত্মসম্মান, লজ্জা এসবকিছু আনিস সাহেবের কাছে কিছু হলেও একজন গরিব অসহায়ের একমাত্র সম্বল কিন্তু স্যার এটিই। তাদের হয়তাে টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ নেই কিন্তু তাদের রয়েছে আত্মসম্মানবােধ। কুলসুম বেগমকে অনেক কষ্টে রাজি করাই ঘটনাটি আমার কাছে খুলে বলার জন্য। এক পর্যায়ে রাজিও হয়। কুলসুম বেগম যখন কথা বলতে শুরু করে ঠিক তখন আমি আমার ফোনটার রেকর্ড মােড অন করে রেখেছিলাম । কুলসুম বেগমের সমস্ত কথা আমি আমার ফোনে রেকর্ড করি ।




আদালত তখন নিস্তব্ধ, যারা এতক্ষণ জারিফ সাহেবকে বােকা কিংবা কিলােসপি স্পেশালিস্ট বলে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়েছিল সবাই এখন তার বুদ্ধির কাছে পরাজিত হলাে। আনিস সাহেবের গলা শুকিয়ে গেল । আইনজীবীর মুখের ভাষাতেও তখন জড়তার ছাপ লক্ষণীয়। জজ সাহেব রেকর্ডটি চালানাের অনুমতি দিলেন।




রেকর্ডটি শোনা যকি:


কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে কুলসুম বেগম বলছে, আনিস সাহেব বেশ কিছুদিন ধরেই আমাকে নানাভাবে টাচ করার চেষ্টা করছিলেন। আমি যখন রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতাম আনিস সাহেব পিছন থেকে এসে আমাকে নানাভাবে টাচ করত। আমার খুব অশ্বস্তি লাগত, আমি অনেকবার তাকে বলেছি আপনি এগুলো কেন করছেন। আমার এগুলো ভালো লাগে না। দয়া করে আমার সাথে এসব করবেন না। আনিস সাহেব দিন দিন আরও বেশি এসব করতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলি। তখন তিনি বলেন, তাহলে এই মাসের বেতন তুমি আর পাবে না। মাসের বাকি ছিল মাত্র তিন দিন। ভাবলাম আর তিন দিন কষ্ট করে কাজ করে বেতনটা নিয়ে আমি চলে যাব। জারিফ সাহেব বলে উঠল আপনি কি আনিস সাহেবের স্ত্রী আর তার মেয়েকে এসবকিছু বলেছেন? না, এসবকিছুই বলিনি। শুধু বলেছি আমি আর চাকরি করব না সামনের মাস থেকে। আপনার কাছে কি জানতে চায়নি কেন চাকরি করবেন না? আনিস




সাহেবের বাসায় কিছুদিন পর পরই নতুন কাজের মহিলা আসত এই সব বিষয়গুলাে তাদের কাছে খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল। তাছাড়া তারা সারাদিন বাইরে থাকত। এসব নিয়ে তাদের কোনাে চিন্তাভাবনা ছিল না।




আজ শনিবার আনিস সাহেবের ছুটি ছিল বাসায় আর কেউ নেই। সবাই প্রতিদিনের মতাে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ে। আনিস সাহেব বারান্দায় বসে বই পড়ছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেন। আমি দৌড় দিয়ে বের হয়ে যাব তখন দেখি দরজা ভিতর থেকে তালা মেরে দিয়েছেন আনিস সাহেব। আমি তার কাছে আমার সম্মান ভিক্ষা চাইলাম বললাম আপনি আমার ধর্মের ভাই আমার এত বড় ক্ষতি আপনি কইরেন না। আপনি আমার ভাইয়ের মতাে। আমাকে দয়া করুণ । কিন্তু তিনি আরও হিংস্র হতে থাকলেন এক পর্যায়ে আমাকে মাইর দেয়। আমাকে ফুলের টব দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে আমার শরীর থেকে কাপড় খুলে নেয়। আমি খুব চেষ্টা করেছি নিজেকে বাঁচাতে আমি চিৎকার করেছি কিন্তু আমার চিৎকারে কেউ আসেনি। এক পর্যায়ে তিনি আমার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং আমার সর্বনাশ করতে থাকে।




জীবনে কোনােদিন আমি এক ওয়াক্ত নামাজ মিস করিনি। আমরা গরিব হতে পারি তাই বলে আমাদের কি আত্মসম্মান নেই। আমার ছােট একটা ছেলে রয়েছে আমি কী জবাব দেব তার কাছে। আমার স্বামী সারাদিন রিকশা চালায় আমি কীভাবে লুকাব এই বিষয়। আমি যে তাকে ঠকিয়ে ফেলেছি।




জারিফ বলতে লাগল আপনি তাে পরিস্থিতির স্বীকার। কেন আপনি নিজের উপর এই দায় নিচ্ছেন। দেখবেন আনিস সাহেবের শাস্তি হবে। উপরে একজন আছে, যিনি সব দেখেন তিনি এই অন্যায় সহ্য করবে না। আপনি একটু স্বাভাবিক হন দয়া করে। আমি পুলিশের কাছে গিয়ে সব খুলে বলব। কুলসুম বেগম বলল না ভাই, আপনি দয়া করে কাউকেই আমার এই সর্বনাশের কথা বলবেন না। হয়তাে আনিস সাহেবের শাস্তি একদিন হবে। কিন্তু এ সমাজে আমার সন্তান আর স্বামীর কাছে চিরদিন আমি অপরাধী হয়েই বেঁচে থাকব। আপনি আমার সম্মানটুকু বাঁচান দয়া করে। কাউকেই আপনি আমার এই সর্বনাশের কথা বইলেন না। এই বলে মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদে চলেছিল কুলসুম। আমি নানাভাবে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছি কিন্তু সে কিছুতেই এসব মেনে নিতে পারছিল না। আমি তখন চলে আসি আর বিকেলেই শুনি সে গলায় দড়ি দিয়েছে।




নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯ ধারা মতে সাজাসমূহ :


১. যদি কোনাে পুরুষ কোনাে নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।



২. যদি কোনাে ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপ করার ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তা হলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।



৩. যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনাে নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তা হলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। 




৪. যদি কোনাে ব্যক্তি কোনাে নারী বা শিশুকে


ক. ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানাের বা আহত করার চেষ্টা করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।



খ. ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অন্যবিধ দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।




৫. যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোনাে নারী ধর্ষিতা হন, তাহলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তারা প্রত্যেক, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অন্যবিধ দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।




আদালত সবকিছু শুনে আসামি আনিস সাহেবকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। ইতােমধ্যেই আনিস সাহেবের সাথে সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তার পরিবার। একজন ধর্ষণকারী যে পেশারই থাক না কেন, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে তার অবস্থান সব থেকে নিকৃষ্ট স্থানে।





বাংলাদেশের আলোকে ধর্ষণ


১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে। আর ২০১৬ সালে ২০১৫ সালের তুলনায় ৭৪% বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালে সারা বাংলাদেশে ৮১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৩২ জন নারী। ২০১৯ সালে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪১৩ জন।




আইনের খাতায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ধর্ষণের হত্যা করা হলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড লেখা আছে। মামলা দেওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে এই সাজা কার্যকর করার বিধানও আছে। কিন্তু অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, বেঁধে দেওয়া এই সময়ের মধ্যে তাে নয়ই বরং অনেক দীর্ঘ সময় পর কদাচিৎ নগণ্য সংখ্যকই শাস্তি পায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মাত্র ০.০০৪% অর্থাৎ এক হাজার ধর্ষকের মধ্যে মাত্র চার জন শাস্তি পাচ্ছে। বাকিরা প্রভাব খাটিয়ে কিংবা অর্থের জোরে আইনের ফাকফোকর গলে বেরিয়ে যায়। তারাই আবার নতুন উদ্দামে এই কুকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদেরকে দেখে আরও অনেকেই মদদ পাচ্ছে। এভাবে পুরাতন ও নব্য ধর্ষকের সংখ্যা ও দৌরাত্ম যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।



বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অসুখ হয়েছে আবার সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী সুস্থও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মানুষের ভিতরে থাকা এই অসুখ সারবে কীসে? দিন দিন তাে বেড়েই চলেছে কিন্তু এর শেষ কোথায়? প্রথমত যে, সমাধানটি সবার মাথায় আসবে সেটি হলাে সরকার ব্যবস্থার কোনাে ত্রুটি ধরা কিংবা আইনকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেওয়া। কিন্তু এতেও কি আসবে সমাধান? এই ভাইরাস প্রতিহত করতে হলে একটাই সমাধান সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। বিবেক এবং মনুষ্যত্ববােধ জাগিয়ে তােলা। তাহলেই হয়তাে সম্ভব এই অসুস্থতা থেকে মুক্তি পাওয়া।



Post a Comment

Previous Post Next Post