F মুচি বাংলা গল্প

আমি লিখন, বয়স ছাব্বিশ। সদ্য গ্রাজুয়েট প্রাপ্ত একজন যুবক। পড়াশােনা তাে শেষ করে ফেলেছি। যখন ছাত্র-অবস্থায় ছিলাম তখন কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আমি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে অমুক বর্ষের গণিত ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। বিশ্বাস করেন এখন আর পরিচয় দেওয়ার মতাে কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। তবে হ্যা যদি বইটা প্রকাশ হয়, তাহলে নিজেকে একজন লেখক হিসেবে পরিচয় দেওয়াই যায়। আবার ধরুন পরিচয় দিয়ে আমার লেখা বইটাও উপহার দিয়ে দিলাম। একটু ভাব নিয়ে তখন বলব আমার লেখা দ্বিতীয় বইটা কিন্তু কিছুদিন পরই প্রকাশ হবে। খুব মজার একটা বই লিখছি। পড়ে খুব মজা পাবেন, মন ভালাে হওয়ার বই। আপনার মন খারাপ থাকলে বইটা পেইন কিলারের মতাে কাজ করবে। বইটার প্রতিটি লাইনই আপনাকে বেশ আনন্দ দেবে। এইভাবে নিজের পরের বইটার জন্য মার্কেটিংটাও করা হয়ে যাবে।




ইদানীং দ্বিতীয় বইটা লিখতে লিখতে কেমন জানি একটু কমেডিয়ান হয়ে যাচ্ছি। আমি আমার বইয়ের সেই উদ্ভট চরিত্রে ঢুকে যাচ্ছি। থাক এসব অনেকক্ষণ যাবৎ ট্রেনের অপেক্ষায় গফরগাঁও রেল স্টেশনে বসে রয়েছি।




উদ্দেশ্য ঢাকা যাব। খুব করে টয়লেট চেপেছে। ছােটটা না আসলে, আমাকে বড়টাতে পেয়েছে। যতবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ততবারই কেবল মনে হচ্ছে। আমি টয়লেটে গেলেই ট্রেন চলে আসবে। তাই আর যাব যাব করেও যাওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে একজন এসে হাজির। লােকটি একজন মুচি। মধ্যবয়স্ক, পান দিয়ে গাল ভরতি করে রেখেছে। দাঁতগুলাে সব হলদে। এই লােক মনে হয় কোনােদিনই দাঁত মজেনি। পেটের মধ্যে একটা কাঠের বাক্স ঝুলিয়ে রেখেছে। গায়ের রং বেশ কালাে।


মুচি,বাংলা-গল্প,Fact-Mohi
মুচি - বাংলা গল্প



মুচি ও লিখনের মধ্যে কথােপকথন


মুচি : স্যার আপনের জুতােটাতে রং কইরা দেই। দেখতে ভালাে লাগবাে তাইলে। দামি জুতােখানা, ইসসস রৌদ্রের লাইগা এক্কেবারে ডিসকালার হইয়া গেছে গা।


লিখন : এই জুতােটা যে দামি সেটা আপনাকে কে বলছে? মুচি : স্যার, সেই ছােটবেলা থাইক্কা এই পেশায় আছি। আমার চৌদ্দ


পুরুষ মুচি। আমাদের কাম হইলাে জুতাে মেরামত করা। আর


আমি জুতাে দেখলে চিনব না। আমার একটা অনুমান আছে না।


লিখন : জি না। আপনার কোনাে অনুমানই নাই। এই জুতাে মাত্র তিনশ ত্রিশ টাকা দিয়ে কিনেছি। সেখানে আরও কয়েক ডজন জুতাে রয়েছে। মানুষদের ডেকে ডেকে বিক্রি করছে। দেইক্ষা লইন, বাইচ্চা লইন এক দাম চারশ। 



কী যে করি আর সহ্য হচ্ছে না। এদিকে ট্রেন আসছে না, টয়লেটের চাপও ভীষণ রকমের পেয়ে বসেছে। ধুৎ আর ভাল্লাগে না। চলে গেলাম টয়লেটের খোজে। স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা টয়লেট খুঁজে পেলাম। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়।” আমার ক্ষেত্রে ঠিক এই বিষয়টাই হলাে।



আমি টয়লেটে প্রবেশ করার সাথে সাথে ট্রেনটাও স্টেশনে প্রবেশ করে ফেলেছে। আমার কাজ সেরে দৌড়ে স্টেশনে গিয়ে দেখি ট্রেনটাও আমাকে রেখে দৌড় দিয়ে দিয়েছে। ব্যাস জীবনের খাতায় আরেকটা ব্যর্থতা যােগ হলাে। রাগ পরিমাপ করার কোনাে যন্ত্র কেন এখনও আবিষ্কার হলাে না, এটা ভেবে আমার আরও রাগ হচ্ছে। বসে পড়লাম স্টেশনে পড়ে থাকা একটা কাঠের বেঞ্চে। ঠিক এই মুহূর্তে আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তাে মুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে রাগ কমানাের চেষ্টা চালাত। আফসােস আমি তাে সিগারেট খেতেও জানি না।




চুপচাপ বসে থেকে মুচির জুতাে সেলাই দেখছি। বাহ কত সুন্দর করে মুহূর্তের মধ্যেই একটা আধা-মরা জুতােটাকে কেমন তার যৌবনে ফিরিয়ে দিল। কী সুন্দর হাতের কাজ! এর মধ্যে একজন ভদ্রলােক মুচির কাঠের বাক্সে পা উঠিয়ে দিয়ে বলছে, এই আমার জুতােটাকে একটু পালিশ করে দেয়। মুচির সরল উক্তি, জি জনাব। ভদ্রলােকটি আবার বলে উঠল, এই দেখিস সাবধানে করিস। তাের হাতের স্পর্শ যেন আমার শরীরে না লাগে। এইবার আর কোনাে কথা না বলে ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল মানুষটার দিকে কিছুক্ষণ। না এই ভদ্রলােকের মুচির চোখের ভাষা বুঝানাের মতাে ক্ষমতা নেই।




আমি পড়ে ফেলেছিলাম ঐ দুচোখের ভাষা। আমি স্পষ্টই দেখতে পেয়েছি কতটা কষ্ট পেয়েছে মুচি। হয়তাে মনে মনে বলছে জনাব আমরা গরিব কিংবা নিচু জাত বলে কি আমরা মানুষ না। আমাদের ছোঁয়া লাগলে আপনার কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে।



যাহােক, আমি বুঝলাম না। আজকের দিনে এসেও মানুষ তাদের পুরানাে অভ্যাসগুলাে এখনও ছাড়তে পারল না। এটা ভেবেই অবাক লাগছে। এখনও আঁকড়ে ধরে রেখেছে পূর্ব পুরুষদের দাম্ভিকতা আর শ্রেণিবৈশম্যকে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ জাত-ধর্ম এগুলােকে বড় করে দেখত। তখন মানুষ নির্বাচন করা হতাে কেবল অর্থ-বিত্ত আর জাত দেখে। সমাজে এই পেশাজীবী মানুষগুলাে সব সময় অবহেলিতই থেকে গিয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে সবকিছুই, শুধু পরিবর্তন হয়নি আমাদের মন-মানসিকতা। বিকশিত হয়নি আমাদের মনুষ্যত্ববােধ।




এই মুচিটা আমার কাছেও এসেছিল আমার জুতাে পালিশ করে দিতে। ভাবছি এই পালিশের ছলে কিছুক্ষণ কথা বলে নেব লােকটার সাথে। লােকটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে হাসিমুখে আমাকে জিজ্ঞেস করছে কী স্যার, পালিশ করাইবেন? আমি বললাম, জি হ্যা। মুচি আমার পায়ে হাত দিয়ে আমার জুতাে খুলে দিতে চাচ্ছে। আমি বললাম আপনি পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন। আমি খুলে দিচ্ছি তখন মুচি আমাকে একজোড়া পুরাতন জুতাে এগিয়ে দিল।




আমি গল্প শুরু করলাম– আচ্ছা ভাই আপনার নাম কী? একটা হাসি দিয়ে বলল, আনন্দ চন্দ্র দাস। ভাই একটা লােক দেখলাম আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করছিল, কী হয়েছিল ভাই আমাকে কি বলবেন? তেমন কিছু না স্যার, এইসব তাে আমাগাে প্রতিদিনকার ঘটনা। কত মানুষ কত খারাপ ব্যবহার করে কত কী বলে। তয় এইসব আমাগাে গায়ে লাগে । আমাগাে চামড়া হইলাে গিয়া গন্ডারের চামড়ার মতাে শক্ত। ভদ্রলােক বা সাহেবদের কথায় আমরা কষ্ট পাই না। এইগুলা আমাগাে সয়ে গেছে। এ আর এমনকি সেই ছােটবেলা থাইক্কা মানুষের জুতাে সেলাই করি। আগে বাবার সাথে বসতাম। বাপখান মইরা গেল আইজকা আট বছর হইতে লাগল। কত কী দেখছি।




একদিন এক সাহেবের শরীরে হাত লেগে গিয়েছিল বলে আমার বাপেরে বুকে লাত্তি দিয়া ফেলে দিয়েছিল। এখন মানুষজন অনেক ভালাে হইয়া গেছে। আমাগাে গায়ে তাে আর হাত তুলে না। আমাগাে বাপ-দাদারা তাে আরও কত কষ্ট পাইয়া মরছে হেইডার কোনাে হিসেব নাই। তয় একটা কথা মানুষের লাত্তি খাওয়া ভালা কিন্তু ভদ্রলােকেরা আমাগাে খুব খারাপ চোখে দেখে। এই জিনিসটাই আমাগাে কাছে খুব কষ্ট লাগে।




আমরা মুচি বইলা সাহেবরা আমাগাে ঘৃণা করে। বাজারের কোনাে দোকানে বসে আমরা চা খেতে পারি না। একটি চায়ের কাপ দেখিয়ে আমাকে বলতে লাগল এই যে চায়ের কাপটা দেখতেছেন এইটা সবসময় আমার সাথে রাখি, কেন জানেন? আমি বললাম না আপনি বলেন। ছলছল চোখে সে বলতে লাগল এই কাপ নিয়ে গেলে দোকানদার অন্য কাপে চা বানিয়ে উঁচু করে আমার কাপে চা ঢেলে দেয়। তখন যে কী লজ্জা লাগে হেইডা আমি আপনেরে বুঝাইতে পারােম না। আসলে মুচি হইয়া জন্ম নেওয়া একটা বড় অপরাধ। লােকটার ছলছল চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। কতটা অসহায়ত্ব বরণ করে নিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লােকটার অসহায় মুখটা দেখে আমার চোখের কোণেও কিছু জল এসে জমা হয়েছে।




দাঁড়িয়ে থেকে মুচিটার শৈল্পিক কাজ দেখছিলাম। কী করে মুহূর্তের মধ্যেই আমার মৃতপ্রায় জুতােজোড়াকে একেবারে নতুন প্রাণ দিয়ে দিয়েছে। চকচক করছে জুতােজোড়া। এই যে স্যার পরেন আপনের কাম হইয়া গেছে। জি ভাই কত টাকা দেব? স্যার আপনি খুশি হইয়া যাই দেন তাই নেব। আমি একশ টাকা দিলাম। মুচিটা আমাকে পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিচ্ছে। আমি বললাম ভাই আপনি এটা রেখে দেন। তখন লােকটা বলল,



জনাব আমরা মুচি খুব নিচু জাতের মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমাগাে একটা আত্মসম্মান আছে। স্যার কিছু মনে করবেন না। এই টাকাটা আমি নিতে পারব না। আমি অবাক হলাম একজন মুচি হয়েও লােকটার মধ্যে সামান্য পরিমাণ লােভ নেই আর আমরা কত ভালাে অবস্থানে থেকেও আমাদের মধ্যে কত সমস্যা। ঠিক করলাম আজ আর ঢাকা যাব না। মন খারাপ লাগছে খুব। ঠিক করলাম আবার আমি বাড়ি ফিরে যাব। আগামীকাল ঢাকা যাব।



বাড়ি ফিরে গিয়েও বারবার মুচির কথাই মনে পড়তে লাগল। চিন্তা করলাম মুচিদেরকে নিয়ে একটু পড়াশােনা করব। ব্যাস জানতে শুরু করলাম এদের আদি-অন্ত ।




মুচিরা চামার কর্তৃক সংগৃহীত চামড়া ব্যবহারােপযােগী করে তােলেন অথবা বিক্রির জন্য ট্যানারিতে নিয়ে যান। ঐতিহাসিকভাবে মুচিরা হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তারা নিম্নশ্রেণির ও সামাজিকভাবেও তারা অস্পৃশ্য। গ্রামে বা শহরে মহল্লার এক কোণায় আলাদাভাবে বসবাস করে। এ ধরনের মহল্লা মুচি পাড়া নামে পরিচিত। এসব মহল্লা উপেক্ষিতই বলা চলে। আগেকার দিনে এদেরকে প্রায়শ ঋষি বলা হতাে। এরা জুতা, স্যান্ডেল তৈরি, মেরামত ও রং মাখিয়ে পালিশ করার কাজ করতেন। সেই আদি কাল থেকে এখন পর্যন্ত এই পেশায় নিয়ােজিত ব্যক্তিরা এখনও নিচু-শ্রেণির মানুষ বলেই গণ্য।




মুচিদের মূলত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়! যথা : কাশ্যপ এবং শাণ্ডিল্য। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কে বাধানিষেধ নেই। ব্যভিচারের অভিযােগে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং বিবাহবিচ্ছেদপ্রাপ্ত বা বিধবা মহিলাদের পুনঃবিবাহের বিধান আছে। অধিকাংশ মুচি শিব সম্প্রদায়ভুক্ত, তবে তাদের একটা বড় অংশ হলাে বৈষ্ণব। ধর্মীয় উৎসবাদিতে তারা শূদ্রদের অনুকরণ করেন। যাহােক, দিন শেষে আমরা সবাই মানুষ। আমাদের প্রয়ােজনগুলাে কিন্তু আমরা মানুষেরাই মিটিয়ে থাকি। তাহলে কেন আমরাই শ্রেণি কিংবা পেশা, জাত কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে মানুষদেরকে আলাদা করছি। সমাজের এই অসহায় মানুষগুলাের সাথে কি একটু হাসিমুখে কথা বলতে পারি না আমরা। আমরা কি পারি না তাদেরকে শুধু মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে?



মানব তত্ব


লালন শাহকে নিয়ে এখনও একটি বিষয় কিন্তু অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে। তা হলাে তিনি জন্মসূত্রে কী ছিলেন, হিন্দু না মুসলমান এ ব্যাপারে নানা তর্কবিতর্ক ও মতভেদ রয়েছে। লালন শাহ সবসময় নিজেকে জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর গানে লিখেছেন




সব লােকে কয়, লালন কি জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে। কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়, তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়। যাওয়া কিংবা আসার বেলায়, জাতের চিহ্ন রয় কার রে।




মানুষ তার বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা জন্মসূত্রে একটি উপাধি উপহার হিসেবে পেয়ে থাকে। আর আমরা তাদের বংশমর্যাদা, তাদের অর্থ-বিত্ত দ্বারা মানুষের মধ্যে বিভাজন করে দিয়েছি। হিংসটা শুরু হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই। মানুষগুলাে তাদের মানবিকতা হারিয়ে ফেলছে ঠিক সেখান থেকেই। আমাদের কাছে সবার আগে একজন মানুষের পরিচয় হওয়া উচিত একজন মানুষ হিসেবেই। জাত-ধর্ম কি মানুষের ঊর্ধ্বে? মানুষের প্রয়ােজনে তৈরি হয়েছে এসব জাত-ধর্ম। জাত কিংবা ধর্মের প্রয়ােজনে মানুষ তৈরি হয়নি। যাহােক, আমাদের মধ্যে এই বিভাজন কিংবা শ্রেণি-বৈশম্যের জন্যই আজ এই সুন্দর পৃথিবীটা একটা নরকে পরিণত হয়েছে। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে নিয়ে নিন্দায় মেতে উঠেছে। সমাজে ধনী কিংবা উচ্চশ্রেণির মানুষ অসহায় নিপীড়িত মানুষদেরকে নিজেদের প্রয়ােজনে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। এই পৃথিবীতে এসেছিলাম সবাই মানুষ হয়েই কিন্তু কালের বিবর্তনে আমাদের জীবনে এক একটা উপাধি যুক্ত হয়ে আমাদের জীবনকে অতিষ্ট করে দিয়েছে।





ইসলাম যা বলে


মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন : “তােমাদের মধ্যে এমন একটি দল বা গােষ্ঠী থাকা উচিত, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, ভালাে কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে, তারাই সফলকাম।” (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)



একজন ভালাে মানুষ হতে হলে সবার আগে আমাদের দেহ এবং মন সম্পর্কে ভালাে ধারণা রাখতে হবে। একটা পশুর যেমন তার নিজের শরীরের উপর কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই, ঠিক তেমনি শরীরও ভালাে-মন্দের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নির্ণয় করতে জানে না। ভালাে মানুষ হতে হলে আমাদের শরীর বা দেহের উপর বিবেকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। শরীর বা দেহ কখনাে ভালাে-মন্দের নির্ণয় করতে জানে না। ভালাে-মন্দের নির্ণয় করে থাকে আমাদের বিবেক। যার কল্যাণে আমরা আজ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। বিবেক জিনিসটা পশুদের থাকে না। মানুষ যখন তার কাজগুলােকে বিবেক দিয়ে বিচার করে না ঠিক তখনই মানুষ আর মানুষ থাকে না। কারণ বিবেকহীন মানুষ পশুর সমান। বিবেকের প্রয়ােজনে যে মানুষ দেহের দাবিকে অগ্রাহ্য করার সামর্থ্য রাখে সে-ই প্রকৃত ভালাে মানুষ।




ভালাে মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে বিভিন্ন হাদিসে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এসেছে, তার মধ্যে




★ আবু হােরায়র (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবি (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলাে, ভালাে মানুষ কে? জবাবে তিনি বললেন, “ভালাে মানুষ তিনিই যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে।” (বুখারী : ৪৬৮৯)




★ আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,নবি (সা.) বলেছেন, “তােমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যার চরিত্র সবচেয়ে বেশি সুন্দর।” (বুখারী ৩৫৫৯)




★ আবু হােরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, “তােমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে নিজ পাওনাদারের পাওনা উত্তমভাবে পরিশােধ করেন।” (বােখারী : ২৩০৫)




★ আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) এর নিকট আরজ করা হলাে, হে আল্লাহর রসুল সর্বোত্তম মানুষ কে? জবাবে তিনি বলেন—“ঐ ব্যক্তি, যার অন্তর পাপমুক্ত, পরিষ্কার, কারাে প্রতি কোনাে আক্রোশ ও বিদ্বেষ নেই এবং যে সত্যবাদী হয়।” (ইবনে মাজাহ : ৪২১৬) 





★ আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবি (সা.)-কে বলতে শুনেছি, “তােমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি হলাে যাকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়।” (ইবনে মাজাহ : ৪১১৯)




স্থান, কাল, অবস্থা, প্রেক্ষাপটের আলােকে সর্বোত্তম মানুষ বা ভালাে মানুষের পরিচয়গুলাে কে মহানবি (সা.) এভাবে সজ্ঞায়িত করেছেন।




মূলত ভালাে মানুষ বলতে বােঝায় : “যে ব্যক্তি নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে তার সত্তা কিংবা নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্যগুলাে যথাযথভাবে পালন করেন, এবং একই সাথে চরিত্রের ভালাে উপাদানগুলাে গ্রহণ ও মন্দ উপাদানগুলাে বর্জন করেন তিনিই প্রকৃত ভালাে মানুষ।”




লেখকের কিছু কথা


এই বইটির লেখক, খুবই সাধারণ এবং নগণ্য একজন মানুষ। বইটি মূলত লেখকের দায়বদ্ধতা থেকেই লেখা। এটা লেখকের প্রথম বই। তাই লেখকের ভুল-ভ্রান্তিগুলাে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বইটি পড়ে যদি একজনেরও এই অসহায় দরিদ্র-দুঃস্থ মানুষদের জন্য একটুও সহানুভূতি তৈরি হয় তবেই লেখক নিজেকে স্বার্থক মনে করবেন। আসলে আধুনিক এই পৃথিবীতে আমরা নিজেদের নিয়ে দিন দিন খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। এগিয়ে যাওয়ার এই যুদ্ধে আমরা কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নই। প্রতিযাগিতা আমাদের মগজের সাথে মিশে গিয়েছে, তাই হয়তাে দিন দিনই আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেই চলেছে। এভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে হয়তাে অদূরভবিষ্যতে খুব খারাপ কিছুই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আমাদের প্রজন্ম কিংবা আমাদের ছেলেময়েদের এসব মিথ্যে প্রতিযাগিতায় না নামিয়ে এদেরকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিন। আর তা না হলে ভবিষ্যতে আপনার সন্তানের করা বিশাল অট্টালিকায় হয়তাে জায়গা হবে না আপনার। দয়া করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যান দেখবেন সবকিছুই কেমন স্বর্গময় হয়ে উঠবে। ছেলেমেয়েদের প্রতিযাগিতায় নামাবেন না। জীবনে প্রথম হওয়াটাই সবকিছু নয়। ভালাে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিন, সবকিছুই সুন্দর হয়ে যাবে। জাত, ধর্ম কিংবা বর্ণ এসবের প্রয়ােজনে মানুষ সৃষ্টি হয়নি, মানুষের প্রয়ােজনেই সৃষ্টি হয়েছে এসব।




“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।”

Post a Comment

Previous Post Next Post