আমার যখন বারাে বছর বয়স তখন আমার এক বন্ধুর সাথে আর এক বন্ধুর এক ব্যাগ মিষ্টির বাজী হয়েছিলাে। বাজীর বিষয় ছিলাে আমি জীবনে কখনােই কিছু করতে পারবাে না। জানি না এই বাজীর হিসাব কখনাে মেটানাে হয়েছিলাে কি-না। আর মেটানাে হয়ে থাকলেও কে জিতেছিলাে সেটা জানা নেই। এই ঘটনাটা মনে পড়লে এখনাে আমার খুব হাসি পায়।
সব সময় যে খুব একা থাকতাম তা কিন্তু নয়। আমার ছয়-সাত জন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাে। তাদের অধিকাংশের সাথে আমার এখনাে যােগাযােগ আছে। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে খুব দীর্ঘ আলােচনায় মগ্ন থাকতাম। আর সব বিষয়েই আমাদের তর্ক হতাে। যেমন : বেতার-নিয়ন্ত্রিত মডেল (প্রতিরূপ) থেকে ধর্ম পর্যন্ত আবার প্যারাসাইকোলজি (Parapsychology) থেকে পদার্থবিদ্যা পর্যন্ত। যেসব বিষয় নিয়ে আমরা আলােচনা করতাম তার ভেতরে একটা ছিলাে মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্যে এবং মহাবিশ্ব শুরু করার জন্যে সৃষ্টিকর্তা প্রয়ােজন ছিলাে কি-না। আমি শুনেছিলাম সুদূর নীহারিকা থেকে আলাে বর্ণালির লালের দিকে বিচ্যুত হয় এবং এ জন্যে মনে করা হয় মহাবিশ্ব বিস্তারমান (নীলের দিকে বিচ্যুত হলে তার অর্থ হতাে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হচ্ছে)। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, লালের দিকের এ বিচ্যুতির অন্য কোনাে কারণ রয়েছে। হয়তাে আলােক ক্লান্ত হয়ে পড়তে এবং আমাদের কাছে আসার পথে লাল হয়ে যেতাে। মূলগতভাবে অপরিবর্তনশীল এবং চিরস্থায়ী মহাবিশ্বকে মনে হতাে স্বাভাবিক। আমার পি.এইচ.ডি.-র জন্য দু বছর গবেষণার পর আমি বুঝতে পারলাম আমার এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলাে না ।
এই স্কুলের শেষ দু বছরে আমি চেয়েছিলাম গণিত এবং পদার্থবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হতে । মি. তাহ্তা (Mr Tahta) একজন গণিতের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন গণিতে অনুপ্রাণিত। স্কুলে একটা নতুন গণিতের ঘর তৈরি করা হয়েছিলাে। গণিতের লােকেরা । সেখানে নিজেদের শ্রেণিকক্ষ বানিয়ে নিলেন। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন এর ঘাের বিরােধী। তার ধারণা ছিলাে যে মাস্টারি ছাড়া গণিতবিদদের অন্য কোনাে চাকরি ভবিষ্যতে থাকবে না। আসলে আমি ডাক্তার হলেই তিনি খুশি হতেন। কিন্তু জীববিদ্যায় আমার কোনােই আকর্ষণ ছিলাে না। আমার মনে হতাে জীববিদ্যা অতিরিক্ত বিবরণ সর্বস্ব এবং যথেষ্ট মূলগত নয়। তা ছাড়া স্কুলে জীববিদ্যার স্থানও ছিলাে অনেক নিচে। এ বিষয়ে এখানে কোনাে গুরুত্বই পেতাে না।
তা ছাড়া এখানকার সবচেয়ে মেধাবী ছেলেরা গণিত এবং পদার্থবিদ্যা পড়তাে। তার চেয়ে যারা কম মেধাবী তারা পড়তাে জীববিদ্যা। বাবা জানতেন যে, আমি জীববিদ্যা পড়ব না। কিন্তু তিনি আমাকে জোর করে রসায়ন পড়িয়েছিলেন আর সামান্য কিছু গণিতও করিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এর ফলে বিজ্ঞানের যে কোনাে শাখা নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত থাকবে।
আমি এখন গণিতের অধ্যাপক। কিন্তু ১৭ বছর বয়সে সেন্ট অ্যালবান্স স্কুল ছাড়ার পর থেকে গণিতশাস্ত্রে কোনাে প্রথাগত শিক্ষা আমার হয় নি। আমার অগ্রগতির সাথে সাথে আমাকে গণিত শিখে নিতে হয়েছে অর্থাৎ আমি যতােটা গণিত জানি ততােটা শিখতে হয়েছে কেব্রিজে। আমাকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েটদের দেখাশােনা করতে হতাে এবং তাদের শিক্ষাক্রমে তাদের চেয়ে এক সপ্তাহ এগিয়ে আঁকতে হতাে। এগুলাে আমাকে করতে হয়েছে যথেষ্ট আন্তরিকতা দিয়ে।
আমার পরিশ্রমী বাবা ট্রপিক্যাল ডিজিজ নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি মিস্ হিলে আমাকে তার সাথে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যেতেন। ব্যাপারটা আমার খুব ভালাে লাগতাে, বিশেষ করে ভালাে লাগতাে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখা। তিনি আমাকে কীট-পতঙ্গের (Insects) ঘরেও নিয়ে যেতেন। সে ঘরে তিনি ট্রপিক্যাল ডিজিজ সংক্রমিত মশা রাখতেন। আমার দুশ্চিন্তা হতাে। কারণ মনে হতাে কিছু মশা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি খুবই পরিশ্রমী ছিলেন এবং গবেষণা কর্মে ছিলেন উৎসর্গীকৃত প্রাণ।
তার একটি বিদ্বেষ এবং অবজ্ঞার ভাব ছিলাে। কারণ, তার ধারণা ছিলাে যারা অতােটা ভালাে নয় অথচ যাদের বংশপরিচয় উত্তম এবং যােগাযােগ এবং সম্পর্কও ভালাে, তারা তার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে। তিনি এ সব লােক সম্পর্কে আমাকে সাবধান করে | দিতেন। কিন্তু আমার মনে হয় ডাক্তারির সাথে পদার্থবিদ্যার একটু পার্থক্য রয়েছে। তুমি কোন্ স্কুলে পড়েছে কিংবা কার সাথে তুমি সম্পর্কিত তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি কী করছাে এটাই আসল কথা। এটাই তােমার আসল পরিচয়।
আসার সব সময়ই জিনিসগুলাে কী করে চলে সেটা জানার খুব আগ্রহ ছিলাে। আমি সেগুলাে কী করে কাজ করে তা দেখার জন্যে জিনিসিগুলাে খুলে ফেলতাম। কিন্তু সেগুলাে আবার জুড়ে দেওয়ার ব্যাপারে ততাে ভালাে মেধার অধিকারী ছিলাম না। আমার ব্যবহারিক ক্ষমতা কখনােই আমার তাত্ত্বিক অনুসন্ধিৎসার সমকক্ষ ছিলাে না। আমার বাবা আমার বিজ্ঞানে আকর্ষণকে সব সময়ই ব্যাপকভাবে উৎসাহ দিতেন। এমন কি তিনি আমাকে অনেক গণিতও পড়িয়েছেন।
তবে আমার বিদ্যা যতাে দিন না তার বিদ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে ততাে দিন পর্যন্ত আমার এ পশ্চাৎপট আর বাবার কর্মক্ষেত্র এ রকম থাকার ফলে আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, আমি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করবাে। অল্প বয়সে আমি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ভেতরে কোনাে পার্থক্য করি নি। কিন্তু তেরাে-চৌদ্দ বছর বয়স থেকে আমি জানতাম, আমি পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করতে চাই। কারণ, পদার্থবিদ্যাই ছিলাে মূলগত বিজ্ঞান। এটার । প্রতি আমার আকর্ষণও ছিলাে প্রবল।
আরও পড়ুন,
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
অবশ্য পদার্থবিদ্যা আমার স্কুলের সবচেয়ে এক ঘেয়ে বিষয় ছিলাে। তার কারণ, এটা ছিলাে এত সহজ এবং স্বতঃপ্রতীয়মান কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার পদার্থবিদ্যাই পছন্দ ছিলাে। রসায়নশাস্ত্রে মজা ছিলাে অনেক বেশি। কারণ, বিস্ফোরণের মতাে অপ্রত্যাশিত ঘটনা প্রায়ই ঘটততা। কিন্তু পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের আশা দিতাে, আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং কেন আমরা এখানে এসেছি সেটা অনুধাবন করার। আমি আমার জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে মহাবিশ্বের গভীরতা মাপতে চেয়েছিলাম। হয়তাে আমি খানিকটা সফলও হয়েছি। কিন্তু এখনাে আমার জিজ্ঞাসা প্রচুর। আমি এখনাে এসব নিয়ে চিন্তায় মগ্ন থাকি। আমি ভাবি। আমি সিদ্ধান্ত নিতে চাই। আমি সঠিকটা জানতে । চাই, জানাতে চাই।
Post a Comment