এ সময় একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটলাে। পরিবারের আর সবাই এক বছরের জন্যে ভারতে চলে গেলেন। কিন্তু আমি রয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং A লেভেল (A level) পরীক্ষার জন্যে। আমার প্রধান শিক্ষকের মতে, অক্সফোর্ডে চেষ্টা করার পক্ষে আমার বয়স খুবই কম ছিলাে। কিন্তু আমি ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে আমাদের স্কুলে আমার উপরের ক্লাসের দুটি ছেলের সাথে স্কলারশিপ পরীক্ষা দিতে গেলাম। আমার বিশ্বাস ছিলাে আমার পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়েছে।
প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারাররা অন্য সবার সাথে কথা বলতে এলেন, কিন্তু আমার সাথে কথা বললেন না। তারপর অক্সফোর্ড থেকে ফেরার কয়েক দিন পরে টেলিগ্রাম পেলাম যে, আমি একটা স্কলারশিপ পেয়েছি।
আমার বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর। অন্য সব ছাত্রই সামরিক বাহিনীতে কাজ করার পর ভর্তি হয়েছিলাে। তাদের বয়স ছিলাে আমার চেয়ে অনেক বড়। আমার সেখানে নিজেকে খুব একা লাগতাে। কেবল তৃতীয় বছরে সেখানে আমার ভালাে লেগেছে। তখনকার দিনে অক্সফোর্ডের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলাে অত্যন্ত কর্ম বিরােধী। সবাই চাইতাে, আপনি খুব মেধাবী (Brilliant) হবেন কিন্তু খাটবেন না কিংবা আপনি নিজের ক্ষমতার সীমা মেনে নিয়ে একটা চতুর্থ শ্রেণির ডিগ্রী নিয়ে বের হবেন। ভালাে ডিগ্রির জন্যে কঠিন পরিশ্রম করাকে মনে করা হতাে রূপালি মানুষের (বৃদ্ধ) লক্ষণ। অক্সফোর্ডের শব্দভাণ্ডারে এটাই ছিলাে সবচেয়ে খারাপ বিশ্লেষণ। এটা আমাকে ভীষণভাবে আলােড়িত করে। সে সময় অক্সফোর্ডের পদার্থবিদ্যার পাঠক্রম এমনভাবে সাজানাে হয়েছিলাে যে, কোনাে রকম খাটুনি না করা ছিলাে অত্যন্ত সহজ। উপরে ওঠার আগে আমি একটা পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তারপর তিন বছর আমি অক্সফোর্ডে পড়েছি এবং তারপর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। একবার হিসাব করে দেখেছিলাম ওখানে যে তিন বছর ছিলাম সেই তিন বছরে আমি কাজ করেছিলাম প্রায় এক হাজার ঘণ্টা। অর্থাৎ গড়ে দিনে এক ঘণ্টা। এ কর্মহীনতায় আমার কোনাে গর্ব নেই। আমি কেবল তখনকার দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছি। আমার সহপাঠী ছাত্রদের অনেকেরই এ দৃষ্টিভঙ্গি ছিলাে। এ দৃষ্টিভঙ্গি ছিলাে সম্পূর্ণ একঘেঁয়েমির (Boredom) আর খাটুনি করার মতাে কোনাে কিছুরই অস্তিত্ব অস্বীকার করার। আমার অসুস্থতার একটা ফল হয়েছিলাে এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আপনি যদি দ্রুত মৃত্যুর মুখােমুখি হন তাহলে উপলব্ধি করবেন বেঁচে থাকার একটা বড় মূল্য আছে এবং আপনার অনেক কিছু করার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। তখন আশা অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়।
এ সময় আমার কর্মহীনতার জন্যে আমি ঠিক করেছিলাম তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় সমস্যা নিয়ে কাজ করে ফাইনাল পরীক্ষা দিব এবং যে সমস্ত প্রশ্নে ঘটনাবলি সম্পর্কে জ্ঞান (Factual Knowledge) প্রয়ােজন সে প্রশ্নগুলাে এড়িয়ে যাবাে। পরীক্ষার আগের রাতে উৎকণ্ঠার জন্যে আমি ভালাে ঘুমােতে পারি নি। সে জন্যে আমি খুব ভালাে করি নি।
আমি ছিলাম প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ডিগ্রির মাঝামাঝি এবং পরীক্ষকদের আমি কোন্ শ্রেণি পাবাে সেটা ঠিক করার জন্যে আমাকে ইন্টারভিউ (Interview) করতে হয়েছিলাে। পরীক্ষার সময় ওরা আমাকে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত সব জিজ্ঞাসা করলেন। ওরা আমাকে প্রথম শ্রেণির ডিগ্রিই দিয়েছিলেন । আমাকে নিয়ে তাদের আশা ছিলাে যথেষ্ট।
তখন আমার মনে হয়েছিলাে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় আমার গবেষণা করার মতাে দুটি মূলগত বিষয় আছে। তার একটা হলাে মহাবিশ্ব তত্ত্ব (Cosmology) অর্থাৎ অতি বৃহৎ নিয়ে গবেষণা আর একটা ছিলাে মৌলকণা (Elementary Particles) অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র নিয়ে গবেষণা। আমি ভাবলাম মৌলকণাগুলাের আকর্ষণ কম। কারণ যদিও নতুন নতুন অনেক মৌলকণা আবিষ্কৃত হচ্ছে তবুও উপযুক্ত কোনাে তত্ত্ব সে সময় ছিলাে না। বৈজ্ঞানিকতার কেবল কণাগুলােকে বিভিন্ন গােষ্ঠীতে সাজাতে পারতেন, যেমন করা হয় উদ্ভিদবিদ্যায় (Botany)। অন্যদিকে মহাবিশ্ব তত্ত্বে ছিলাে একটা সুসংজ্ঞিত তত্ত্ব— আলবার্ট আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ'। অক্সফোর্ডে তখন মহাবিশ্ব তত্ত্ব নিয়ে কেউ গবেষণা করতেন না। কিন্তু কেমূব্রিজে ফ্রেড হয়ে (Fred Hoyle) ছিলেন। তিনি ছিলেন তখনকার দিনে ব্রিটেনের সবচেয়ে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। সুতরাং আমি ফ্রেড হয়েলের কাছে গবেষণার জন্যে একটি দরখাস্ত করলাম। কেব্রিজে আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হলাে। তবে শর্ত ছিলাে আমাকে প্রথম শ্রেণি পেতে হবে। কিন্তু যখন দেখলাম ডেনিস্ কিয়ামা (Denis Sciama) নামে এক ভদ্রলােকের কাছে আমাকে গবেষণা করতে হবে, তিনি হয়ে নন, আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। ডেনিস কিয়ামার কথা আমি তখনাে শুনি নি। শেষ পর্যন্ত কিন্তু এটাই সবচেয়ে ভালাে হয়ে দাঁড়ালাে। হয়ে খুব বেশি বাইরে থাকতেন এবং তার কাছে থেকে খুব বেশি সময় পাওয়া যেতাে না। অন্য দিকে কিয়ামা সেখানেই থাকতেন, আমাকে সব সময় সাহস ও উদ্দীপনা দান করতেন। অবশ্য আমি তার চিন্তা-ধারার সাথে সব সময় একমত হই নি। যা পরবর্তীতে আমি ব্যাখ্যা করেছি। অবশ্য আমি স্কুলে কিংবা অক্সফোর্ডে গণিতের চর্চা খুব বেশি করি নি। সে জন্যে প্রথমে ব্যাপক অপেক্ষবাদ’ খুবই কঠিন মনে হতাে এবং আমি খুব এগুতে পারি নি। তা ছাড়া অক্সফোর্ডের শেষ বছরে আমি লক্ষ্য করলাম আমার চলাফেরা কী রকম জবরজং হয়ে পড়েছে। কেব্রিজ পৌঁছানাের কিছু দিন পর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমার রােগ নির্ণয় করা হলাে।
ইংল্যান্ডে আমার রােগটার নাম এ.এল.এস. (Amyotrophic Lateral SclerosisALS) কিংবা মােটর নিউরন ডিজি’ (Motor Neurone Disease), আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এটাকে ‘লু গেরিগের ব্যাধি’ (Lou Gehrig's Disease)ও বলে। ডাক্তাররা এ রােগের নিরাময়ের কোনাে উপায় আমাকে জানাতে পারেন নি। এমন কি এ রােগ যে আর খারাপ হবে না এ সম্পর্কেও কোনাে নিশ্চয়তা দিতে পারেন নি। এ রােগটা আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিলাে। আমি উপায় খুঁজতেছিলাম।
আমার এ অসুখটা প্রথমে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে বলে মনে হয়েছিলাে। গবেষণার জন্যে খুব পরিশ্রম করে কোনাে লাভ আছে বলে মনে হয় নি। তার কারণ হলাে পি.এইচ.ডি. করার মতাে অতােদিন বাঁচবাে বলে আশা করি নি। কিন্তু সময় যতাে যেতে লাগলাে রােগও ততাে ধীরগতি হতে লাগলাে। আমি ব্যাপক অপেক্ষবাদ’ও বুঝতে শুরু করলাম আর আমার কাজও সামনের দিকে এগুতে লাগলাে। কিন্তু পার্থক্যের আসল কারণ ছিলাে জেন ওয়াইল্ড (Jane wilde) নামে একটি মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হওয়া। যখন আমার এ.এল.এস. রােগ হয়েছে বলে জানা যায়, মেয়েটির সাথে আমার পরিচয়ও হয় প্রায় সে সময়। শুভ বিবাহ ঠিক হওয়ার ফলে আমি বাঁচার একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেলাম। আমার স্বপ্নের আর বাস্তবতায় একটা মিশেল ঘটতে চললাে।
আরও পড়ুন,
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
এ সময় বিয়ে করতে হলে একটা চাকরি দরকার আর চাকরি পেতে হলে পি.এইচ.ডি-টা শেষ করা একান্ত দরকার। সুতরাং জীবনে এই প্রথম আমি কাজ আরম্ভ করলাম। অবাক হয়ে আমি দেখলাম কাজটা আমার ভালাে লাগে। একে কাজ করা বলা বােধ হয় ঠিক নয়। একজন বলেছিলেন, বৈজ্ঞানিক আর বীরাঙ্গনারা যে কাজ করে আনন্দ পায়, সে কাজের জন্যে তারা পয়সা পায়।
Post a Comment