আমি গভি (Gonville) এবং কী (Caius) কলেজে রিসার্চ ফেলাে হওয়ার জন্যে দরখাস্ত করেছিলাম। আমার আশা ছিলাে দরখাস্তটা টাইপ করবে জেন্। কিন্তু সে যখন আমার সাথে দেখা করতে এলাে তখন তার হাতটা ভাঙা আর প্লাস্টার করা। আমার মানতেই হবে যে, যতােটা সহানুভূতি থাকা উচিত ছিলাে ততােটা সহানুভূতি আমার ছিলাে । ওর বাম হাতটা ভেঙেছিলাে। সুতরাং ও ডান হাতে আমার কথা মতাে দরখাস্ত লিখতে পেরেছিলাে। টাইপ করে দিয়েছিলেন অন্য একজন।
আমার এই দরখাস্তে এমন দু জনের নাম দেওয়ার দরকার ছিলাে যারা আমার গবেষণা সম্পর্কে বলতে পারেন। গবেষণায় আমার অবেক্ষণকারী (Supervisor) বলেছিলেন হারম্যান্ বডি (Hermann Bondi)-কে অনুরােধ করতে এমন একজন হওয়ার জন্যে। বভি তখন লন্ডনে কিংস কলেজের গণিতের অধ্যাপক এবং ব্যাপক অপেক্ষবাদে একজন খ্যাতিমান ব্যাখ্যাদাতা এবং বিশেষজ্ঞ। ওর সাথে আমার বার দুয়েক দেখা হয়েছিলাে। প্রসিডিং অভ দ্য রয়্যাল সােসাইটি (Proceedings of the Royal Society) নামক একটি পত্রিকায় আমার লেখা একটা প্রবন্ধ তিনি জমা দিয়েছিলেন। কেব্রিজে উনি একটা বক্তৃতা দেওয়ার পর আমি তাকে অনুরােধ করলাম। উনি আমার দিকে একটা অনিশ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, হ্যা, উনি সম্মত আছেন।
স্পষ্টতই তার আমাকে মনে ছিলাে না। কারণ কলেজ থেকে যখন তাকে আমার সম্পর্কে জানার জন্যে চিঠি পাঠালাে তখন উনি উত্তর দিলেন যে, আমার সম্পর্কে উনি কিছু শােনেনও নি। আজকাল আবার কলেজে এতাে লােক রিসার্চ ফেলােশিপের জন্যে দরখাস্ত করে যে, কোনাে রেফারি যদি বলেন যে, তিনি প্রার্থীকে চেনেন না, তাহলে তার আর কোনাে আশাই থাকে না।
কিন্তু তখন দিনকাল অনেকটা ভালাে ছিলাে। কলেজ চিঠি লিখে আমাকে এ রকম উত্তরের কথা জানিয়ে দিয়েছিলাে। আমার অবেক্ষণকারী (Supervisor) বন্ডিকে ধরে তার স্মৃতিটা ঝালিয়ে দিয়েছিলেন। বভি তারপর আমার সম্পর্কে এমন ভালাে লিখলেন, যার হয়তাে আমি উপযুক্তই নই। তাই খুব সহজেই আমি ফেলােশিপটা পেয়ে গেলাম। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমি কী কলেজের ফেলােই রয়ে গেছি। আমি আমার কৃতজ্ঞতা দেখাতে পেরেছি।
ফেলােশিপের অর্থ হলাে আমি তখন বিয়ে করতে পারি। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মালে আমরা বিয়ে করি। আমরা সাফোক (Suffolk)-এ হানিমুন করি এক সপ্তাহের জন্যে। আমার আর্থিক অবস্থা তখন ওর চেয়ে ভালাে ছিলাে না। তারপর আমরা নিউ ইয়র্কের ভেতর দিকে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক অপেক্ষবাদের উপর একটা সামার স্কুলে (Summer School) যােগদান করি। তবে ব্যাপারটা ঠিক হয় নি। আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছিলাে বহুলােকের সাথে একটা বড় হলে ঘরে। সেখানে অনেক জোড়া স্বামীস্ত্রী ছিলাে, তাদের ছিলাে অনেকগুলাে বাচ্চা। তারা সব সময় খুব গােলমাল করতাে। ফলে আমাদের বিয়ের উপর বেশ চাপ পড়েছিলাে। অন্যদিকে থেকে এ সামার স্কুলটা খুবই কাজে লেগেছে। ওখানে আমাদের কর্মক্ষেত্রের অনেক নেতৃস্থানীয় সহকর্মীর সাথে পরিচয় হয়েছিলাে। তাদের সাথে অনেক বিষয় আলাপ-আলােচনা হয়েছিলাে।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আমার গবেষণা ছিলাে মহাবিশ্ব (Cosmology) নিয়ে অর্থাৎ বৃহৎ মানে মহাবিশ্ব’ নিয়ে। এ সময় আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছিলাে অনন্যতা (Singularities) নিয়ে। দূরতর নীহারিকাগুলাে নির্দেশ করে—তারা আমাদের কাছ থেকে দূরে অপসারণ করছে, মহাবিশ্বের বিস্তার ক্রমশ বেড়ে চলছে। এর নিহিতার্থ হলাে যে, অতীতে এ নীহারিকাগুলাে নিকটতর ছিলাে।
তারপরেও প্রশ্ন জাগে, এমন কি কোনাে সময় ছিলাে যখন নীহারিকাগুলাে পরস্পরের উপর চাপানাে ছিলাে এবং মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিলাে অসীম (Unlimited)? নাকি অতীতে আর একটি সঙ্কোচন দশা (Contracting Phase) ছিলাে যখন নীহারিকারা পরস্পরকে আঘাত করা এড়াতে পেরেছিলাে? হয়তাে তারা পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে আবার পরস্পর থেকে দূরে অপসারণ আরম্ভ করেছিলাে।
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে নতুন গাণিতিক সাধনার বিশেষ প্রয়ােজন ছিলাে। এগুলাে বিকাশ লাভও করে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ভেতরে। এ কাজ করেছিলাম প্রধানত আমি এবং সে সময় বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী রজার পেরােজ। পেরাে তখন ছিলেন লন্ডনের বার্কবে (Birkbeck) কলেজে, এখন তিনি আছেন অক্সফোর্ডে। ব্যাপক অপেক্ষবাদ সত্য হলে অতীতে নিশ্চয়ই একটা অসীম ঘনত্বের অবস্থা ছিলাে : এ তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য আমি ঐ গাণিতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলাম। অসীম ঘনত্বের অবস্থাকে বলা হয় ‘বৃহৎ বিস্ফোরণ অনন্যতা' (Big Bang Singularities)। এর অর্থ হলাে ব্যাপক অপেক্ষবাদ যদি নির্ভুল হয় তাহলে মহাবিশ্ব কী করে শুরু হলাে, বিজ্ঞান সে বিষয়ে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু আমার আরাে আধুনিক গবেষণা নির্দেশ করে যে, কণাবাদী বলবিদ্যা তত্ত্ব’ অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র তত্ত্বের সাহায্য গ্রহণ করলে মহাবিশ্বের আরম্ভ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। আর তা সত্য হবে।
ব্যাপক অপেক্ষবাদের আর একটি ভবিষ্যদ্বাণী হলাে : ‘পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে বৃহৎ ভরসম্পন্ন তারকাগুলাে নিজেদের উপর চুপসে যাবে। আমার এবং রজার পেরােজের গবেষণায় দেখা যায়, যততক্ষণ পর্যন্ত তারা অসীম ঘনত্বের অনন্যতায় না পৌঁছাবে ততােক্ষণ তারা চুপসে যেতেই থাকবে। এ অনন্যতা হবে কালের সমাপ্তি, অন্ততপক্ষে ঐ তারকা এবং তার উপরে অবস্থিত যে কোনাে বস্তুসাপেক্ষ।
অনন্যতার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতাে শক্তিশালী হবে যে আলােক তার নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে বের হতে পারবে না, বরং সেই আলােককে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র পেছনে টেনে রাখবে। যে অঞ্চল থেকে নিষ্ক্রমণ সম্ভব নয় তার নাম কৃষ্ণগহ্বর (Black Holes) এবং তার সীমানাকে বলা হয় ‘ঘটনা দিগন্ত’ (Event Horizon)। যে কোনাে বস্তু কিংবা ব্যক্তি ঘটনা দিগন্ত দিয়ে এ কৃষ্ণগহ্বরে পড়লে অনন্যতায় এসে সে কালের সমাপ্তিতে পৌঁছাবে।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে আমার মেয়ে লুসির জন্মের কয়েক দিন পর এক রাতে বিছানায় শুতে পারলাম যে, আমি আর যাওয়ার সময় কৃষ্ণগহ্বরের কথা ভাবছিলাম। তখন আমি পেরাে অনন্যতা প্রমাণ করার জন্যে যে প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছি সেগুলাে কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়। বিশেষ করে ঘটনা দিগন্তের এলাকা অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা কালে কালে হ্রাস পেতে পারে না এবং দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষের পর তারা সংযুক্ত হয়ে যদি একটি কৃষ্ণগহ্বর গঠন করে তাহলে অন্তিম গহ্বরের দিগন্ত প্রাথমিক কৃষ্ণগহ্বরগুলাের দিগন্তের এলাকার (Area) চেয়ে বেশি হবে। সংঘর্ষে কতােটা শক্তি বিচ্ছুরিত হবে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ সীমা এর ফলে তৈরি হলাে। আমি এততাই উত্তেজিত হয়েছিলাম যে, সে রাতে যেনাে আমার ঘুম আসছিলাে না একটুও। আমি কেবল ছটফট করছিলাম।
১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আমি কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করেছি। কিন্তু ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বােধ হয় সবচেয়ে আশ্চর্যজনক আবিষ্কার করেছিলাম। কৃষ্ণগহ্বর সম্পূর্ণ কৃষ্ণ নয়”—ক্ষুদ্র মানে পদার্থের আচরণ বিচার করলে দেখা যায় যে, কৃষ্ণগহ্বর থেকে কণিকা এবং বিকিরণ বের হতে পারে। কৃষ্ণগহ্বর তপ্ত বস্তুপিয়ে মতাে বিকিরণ উৎসর্জন (Emit) করতে পারে। এটি আমাকে গভীরভাবে আরাে ভাবিয়ে তােলে।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যার সমন্বয় করে একটি সঙ্গতিপূর্ণ তত্ত্ব করার চেষ্টা করছি। সান্তা বারবারাতে (Santa Barbara) আমি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম্ হার্ট (Jim Hartle)-এর কাছে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম সেই প্রস্তাব এরই ফল। প্রস্তাবটা হলাে, কাল এবং স্থান (Space and time) দুটিই সীমিত। কিন্তু এদের কোনাে সীমানা কিংবা কিনারা নেই। তারা হবে অনেকটা পৃথিবীর পৃষ্ঠের মতাে কিন্তু তাদের আরাে দুটি মাত্রা (Dimension) থাকবে। পৃথিবীপৃষ্ঠের এলাকা সীমিত। কিন্তু তার কোনাে সীমানা নেই। আমার সমস্ত ভ্রমণেও কখনাে আমি পৃথিবীর কিনারা থেকে পড়ে যেতে পারি নি।
গল্পটা মিথ্যে নয় - সকল পর্ব
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
এ প্রস্তাব যদি সত্য হয় তাহলে কোনাে অনন্যতা (Singularity) থাকবে না এবং বিজ্ঞানের বিধিগুলাে সর্বত্রই প্রযােজ্য হবে, এমন কি মহাবিশ্বের শুরুতেও। মহাবিশ্ব কী করে শুরু হবে সেটাও স্থির করবে বিজ্ঞানের বিধি । আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলাে, মহাবিশ্ব কী করে শুরু হলাে সেটা আবিষ্কার করা। হয়তাে সে প্রচেষ্টায় আমি সাফল্য লাভ করতাম কিন্তু আমি এখনাে জানি না কেন পৃথিবী শুরু হলাে। এখানে সৃষ্টিকর্তার কোন্ ধরনের অথবা কী হাত রয়েছে তার নিগূঢ় উদ্দেশ্যই বা কী?
Post a Comment