আমাকে নিয়ে মানুষ ভাবে। আমাকে নিয়েও মানুষের জিজ্ঞাসা আর কৌতুহলের শেষ নেই। আমাকে অনেক সময়ই জিজ্ঞাসা করা হয়, এ.এল.এস. নিয়ে থাকতে আপনি কেমন বােধ করেন?' আমার উত্তর হলাে, খুব বেশি কিছু নয়। আমি যতােটা সম্ভব স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে চেষ্টা করি, আর চেষ্টা করি নিজের অবস্থা নিয়ে না ভাবতে কিংবা যে সব জিনিস করতে পারি না তার জন্যে দুঃখ না করতে। সে কাজগুলাে সংখ্যায় খুব বেশি নয়। আমি কেবল কাজ করে যাচ্ছি। এর মাঝেই আমি আনন্দ পাচ্ছি।
সেই প্রথম দিককার ঘটনা। হ্যা, আমার মােটর নিউরন ডিজিস্ হয়েছে জানতে পেরে আমি মনে একটা জোর ধাক্কা খেয়েছিলাম। শৈশবে আমার দৈহিক সমন্বয় খুব একটা ভালাে ছিলাে না। আমি বল খেলায় খুব ভালাে ছিলাম না, হয়তাে সে জন্যে আমি খেলাধূলা কিংবা দৈহিক ক্রিয়া-কর্ম তেমন গ্রহণ এবং চেষ্টা করি নি। মনে হয় অক্সফোর্ডে যাওয়ার পর ব্যাপারটা একটু পরিবর্তন হয়েছিলাে। আমি হাল ধরা আর নৌকা চালানাে শুরু করেছিলাম । বােট রেসে (Boat Race-নৌকাবাইচ প্রতিযােগিতা) যাওয়ার মতাে ছিলাম না, তবে ইন্টারকলেজে প্রতিযােগিতায় নামবার মতাে অবস্থা আমার ছিলাে। তবে আমি ততােটা আগ্রহ বােধ করি নি।
তারপর অক্সফোর্ডে তৃতীয় বছরে কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম যে, চলা-ফেরায় আমি জবরজং হয়ে যাচ্ছি। একবার, দু বার বিনা কারণে পড়েও গেলাম। কিন্তু পরের বছর কেব্রিজ যাওয়ার পরেই মা ব্যাপারটা ভালােভাবে লক্ষ্য করলেন এবং পারিবারিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তখনই আমাকে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠালেন। আমার একুশতম জন্মদিনের কয়েক দিন পরেই আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। হাসপাতালে ছিলাম মাত্র দু সপ্তাহ। সে সময় নানা রকম পরীক্ষা হলাে। ওরা আমার বাহু থেকে খানিকটা মাংসপেশী কেটে নিলেন, আমার গায়ে কতােগুলাে ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে দিলেন, আমার শিরদাঁড়ার ভেতরে রঞ্জনরশ্মির কাছে অস্বচ্ছ এ রকম কিছু তরলপদার্থ ঢুকিয়ে দিলেন আর খাটটা নেড়ে-চেড়ে দেখলেন যে, সেটা উপর-নিচে কীভাবে যাতায়াত করে।
এসব করেও কিন্তু ডাক্তাররা বললেন না যে, আমার কী হয়েছে। বললেন, রােগী হিসেবে আমি একটি ব্যতিক্রম (A Typical)। আমি কিন্তু জানতে পারলাম যে, তাদের আশঙ্কা-রােগটা ক্রমশই খারাপ হবে এবং ভিটামিন্ দেওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। আমি ভালােভাবেই বুঝতে পারছিলাম এগুলােতে কোনাে কাজ হবে বলে ওরা আশা করেন নি। এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে আমার ইচ্ছে করে নি। কারণ, স্পষ্টতই খবরটা খারাপই। হয়তাে আমি দিন দিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। হয়তাে এটাই অনিবার্য। আমি এমন একটা রােগে ভুগছি যেটা সারবে না এবং কয়েক বছরের ভেতরেই আমার মৃত্যু হবে—এই বােধ একটা মানসিক আঘাত সত্যিই আমাকে দিয়েছিলাে। আমার এ রােগ হলে কী করে? কেন আমার জীবন এভাবে শেষ হবে? কিন্তু আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম তখন আমার উল্টো দিকের বিছানায় একটি ছেলে মারা গেলাে। আমি আবৃছা আবৃছা বুঝতে পেরেছিলাম রােগটা ছিলাে লিউকেমিয়া। দৃশ্যটা আমার কাছে একটুও সুন্দর মনে হয় নি। স্পষ্টতই এমন অনেক লােক আছেন যাদের অবস্থা আমার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। আমার অন্ততপক্ষে নিজেকে রােগী মনে হয় না। যখন আমার নিজের জন্যে দুঃখ করতে ইচ্ছা করে তখন আমি ঐ ছেলেটির কথা মনে করি। বার বার সে যেনাে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি চোখ বন্ধ করলেই তাকে দেখি।
আমার পরিণতি কিংবা আমার কী হবে জানতাম না। একটা অনিশ্চিত অবস্থায় আমি ছিলাম। ডাক্তার আমাকে বললেন কেব্রিজে ফিরে গিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে। আমি তখন ব্যাপক অপেক্ষবাদ’ এবং মহাবিশ্ব’ নিয়ে গবেষণা সবে শুরু করেছি। তবে বেশি এগুতে পারছিলাম না। কারণ আমার অঙ্কের ভিতটা তেমন ভালাে ছিলাে না। তা ছাড়া আমি হয়তাে পি.এইচ.ডি. শেষ করার মতাে অতাে দিন বেঁচে না-ও থাকতে পারি। নিজেকে একটা বিয়ােগান্ত কাহিনীর চরিত্র বলে মনে হচ্ছিলাে। আমি ওয়াগনার (Wagner) শুনতে শুরু করলাম। কিন্তু পত্র-পত্রিকার প্রবন্ধগুলােতে যে বলা হয়েছে আমি খুব বেশি মদ খেতাম, সেটা একটু বাড়াবাড়ি। অসুবিধাটা হলাে, কোনাে একটা প্রবন্ধে এ কথা লেখা হলেই অন্য প্রবন্ধে সেটা নকল করা হয়। তার কারণ, কাহিনীটা ভালাে। বার বার ছাপার অক্ষরে যেটা বােরােয় সেটাই সত্যি। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি।
দুর্ভাবনার সময় আমার স্বপ্নগুলােও গােলমেলে হয়ে গিয়েছিলাে। রােগ নির্ণয় হওয়ার আগে জীবনটাই আমার একঘেয়ে লাগছিলাে। করার মতাে কিছু আছে বলে মনে হতাে । কিন্তু হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার কয়েক দিন পরই স্বপ্নে দেখলাম যে, আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলাে আমার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ হলে আমি অনেক কাজের কাজ করতে পারি। আর একটা স্বপ্ন আমি কয়েক বার দেখেছি, সেটা হলাে আমি পরের জন্যে জীবন উৎসর্গ করবাে। আমাকে যদি মরতেই হয় তাহলে এভাবে মরলে হয়তাে ভালাে কিছু হবে। এটি আমাকে যেনাে নতুন জীবন দিতে শুরু করলাে। আজকে আশার কথা যে, আমি মরি নি। আসলে যদিও আমার ভবিষ্যৎ ছিলাে কালাে মেঘে ঢাকা, তবুও আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে, আমি অতীতের চেয়ে বর্তমানকে বেশি উপভােগ করছি। আমার গবেষণাও সামনের দিকে এগুতে লাগলাে। আমার বিয়ে ঠিক হলাে—বিয়েও করলাম। কেব্রিজে কী কলেজে (Caius College) রিসার্চ ফেলােশিপ পেলাম। দিনগুলাে ভালােই কেটে গেলাে।
কীজ কলেজের ফেলােশিপ আমার তাৎক্ষণিক বেকার সমস্যার সমাধান করলাে। আমার ভাগ্য ভালাে যে, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় গবেষণার কাজ বেছে নিয়েছিলাম। কারণ যে কয়েকটা ক্ষেত্রে আমার অবস্থা বিশেষ কোনাে অসুবিধা সৃষ্টি করতাে না, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা তার ভেতরে একটা আমার ভাগ্য ভালাে ছিলাে। কারণ আমার অক্ষমতা যেমন বেড়েছে, বৈজ্ঞানিক হিসেবে আমার খ্যাতিও তেমনি বেড়েছে। এর অর্থ হলাে, ললাকে আমাকে পর পর এমন পদ দিতে রাজি ছিলাে, যে পদে আমার কেবল গবেষণাই করতে হতাে, বক্তৃতা দিতে হতাে না। এটি আমার অনেক উপকার করেছিলাে।
বাসস্থানের ব্যাপারেও আমার ভাগ্য ভালাে ছিলাে। জে তখনাে লন্ডনের ওয়েস্টফিল্ড কলেজে (Westfield College) আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে (তখনাে বি.এ., বি.এস-সি'র মতাে স্নাতক হয় নি)। সুতরাং সমস্ত সপ্তাহ তাকে লন্ডন অবধি যেতে হত। এর অর্থ ছিলাে আমাদের এমন কোনাে জায়গা খুঁজে বের করতে হতাে যেখানে আমি নিজের কাজ নিজেই করতে পারি এবং যে জায়গা কেন্দ্রে অবস্থিত। তার কারণ আমি বেশি দূর হাঁটতে পারতাম না। কলেজ কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, তারা কোনাে সাহায্য করতে পারেন কিনা। কিন্তু কলেজের তখনকার কোষাধ্যক্ষ আমাকে বললেন, ‘ফেলােদের গৃহসমস্যায় কোনাে সাহায্য না করাই আমাদের কলেজের নীতি।
আরও পড়ুন,
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
বাজারের কাছে কতােগুলাে নতুন ফ্ল্যাট হচ্ছিলাে। অগত্যা আমার সেখানেই ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার জন্যে নাম লেখালাম। (কয়েক বছর পর আমি আবিষ্কার করেছিলাম ঐ ফ্ল্যাটগুলাের মালিক ছিলাে এই কলেজ। কিন্তু ওরা আমাকে সে কথা বলেন নি)। গ্রীষ্মের পর আমেরিকা থেকে কেব্রিজে ফিরে দেখলাম ফ্ল্যাটগুলাে তখনাে তৈরি হয় নি কোষাধ্যক্ষ আমাকে বিরাট খাতির-যত্ন করে গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের হােস্টেলে আমাদের একটা ঘর দিতে চাইলেন। তিনি বললেন, সাধারণত আমরা এক এক রাতের জন্যে এ ঘরগুলাের সাড়ে বারাে শিলিং ভাড়া নিই, তবে আপনারা যেহেতু দু জন সে জন্যে আপনাদের দিতে হবে পঁচিশ শিলিং।'
Post a Comment