আমার আর কোনাে উপায় ছিলাে না। তাই আমরা ওখানে মােটে তিন রাত থেকেছিলাম। তারপর আমি ইউনিভার্সিটিতে আমার ডিপার্টমেন্টের কাছে একটা ছােট বাড়ি পেলাম। বাড়িটা ছিলাে অন্য কলেজের। তারা বাড়িটা নিজেদের একজন ফেলােকে ভাড়া দিয়েছিলাে। কিছু দিন আগে তিনি শহরতলিতে অন্য একটা বাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন। তাদের লিজের (lease) আরাে তিন মাস বাকী ছিলাে। সেই কয় দিনের জন্যে বাড়িটা আমাদের ভাড়া দিলেন। সেই তিন মাসের ভেতরে আমরা ঐ রাস্তার উপরেই একটা খালি বাড়ি পেলাম। বাড়ির মালিক ডরসােটে (Dorset) থাকতেন। আমাদের একজন পড়শি ডসেট (Dorset) থেকে মালিককে ডেকে এনে বললেন, 'ছােকরারা বাড়ি খুঁজছে আর ঐ বাড়িটা খালি পড়ে আছে—এ এক কলঙ্ক!
সুতরাং মহিলা আমাদের বাড়ি ভাড়া দিলেন। ঐ বাড়িতে কয়েক বছর থাকার পর বাড়িটা মেরামত করে নিতে চাইলাম। আমরা কলেজের কাছে বাড়ি বন্ধক রেখে অর্থ-কড়ি ধার চাইলাম। কলেজ বাড়িটা সার্ভে করিয়ে সিদ্ধান্তে এলাে—ওটা বন্ধক রাখার উপযুক্ত নয়। শেষে আমরা একটা বিল্ডিং সােসাইটির কাছে বাড়িটা বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে বাড়ি কিনলাম আর বাবা-মায়ের কাছে টাকা নিয়ে বাড়িটা আমাদের মনের মতাে করে ঠিকঠাক করলাম।
এই বাড়িতে আমরা আরাে চার বছর ছিলাম। ক্রমশ সিঁড়ি ভাঙা আমার পক্ষে খুবই কঠিন হতে লাগলাে। এর ভেতরে কলেজে আমরা একটু দাম বাড়লে আর নতুন একজন কোষাধ্যক্ষ এলেন। তারা নিজেদের একটা বাড়ির এক তলার ফ্ল্যাটটা আমাদের দিতে চাইলেন। বাড়িটার ঘরগুলাে ছিলাে বড় বড় আর দরজাগুলােও ছিলাে চওড়া। সুতরাং আমার পক্ষে বাড়িটা ভালােই ছিলাে। আর অবস্থান ছিলাে শহরের কেন্দ্রের কাছাকাছি। ইলেকট্রিক হুইল চেয়ারে করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টমেন্টে যেতে পারতাম। বাড়িটা খুব ছিলাে বাগানঘেরা। আর বাগানটা দেখা-শােনা করতাে কলেজের মালীরা। তাতে আমাদের তিনজন ছেলে-মেয়ের বেশ খানিকটা সুবিধা হলাে। তারা বাগানে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতাে। চারদিক ঘুরতে-ফিরতাে।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আমি নিজে নিজে খেতে পারতাম, বিছানাতে উঠতে পারতাম আর বিছানা থেকে নামতেও পারতাম। জেই আমাকে সাহায্য করতে পারতাে আর বাচ্চা দুটোকেও মানুষ করতে পারতাে। এর জন্যে বাইরের কারাে সাহায্য লাগতাে না। এরপর কিন্তু ব্যাপারটা আরাে কঠিন হয়ে দাঁড়ালাে। সে জন্যে আমরা আমাদের সাথে একজন গবেষক ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা করলাম। বিনা মূল্যে থাকার ব্যবস্থা এবং আমার যত্ন মনােযােগের বদলে ছাত্রটি আমাকে বিছানায় উঠতে নামতে সাহায্য করতাে।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে আমি একজন কমুনিটি (Community) নার্স এবং একজন প্রাইভেট নার্সের ব্যবস্থা করলাম। তারা সকালে ও বিকালে দু-এক ঘণ্টা করে আসতেন। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে আমার নিউমােনিয়া না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যবস্থাই চলছিলাে। তখন আমার ট্রাকিওস্টমি অপারেশন্ (Tracheostomy—শ্বাসনালীর একটা অপারেশন) হয়। সে সময় আমার দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই নার্সের যত্নের দরকার হতাে। এটা সম্ভব হয়েছিলাে কেবল কয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্যের ফলে। তারা আমার অনেক উপকার করেছিলাে। আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
অপারেশন্ করার আগে আমার কথা ক্রমশই বেশি বেশি জড়িয়ে যাচ্ছিলাে। সে জন্যে যারা আমাদের ঘনিষ্ঠ ছিলাে শুধু তারাই আমার কথা বুঝতে পারতাে। তাহলেও আমি অন্ততপক্ষে নিজের ভাব প্রকাশ করতে পারতাম। আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলাে আমি একজন সেক্রেটারিকে বলতাম—তিনি সেগুলাে লিখে দিতেন। আমি বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিতাম একজন দোভাষীর সাহায্যে। আমার কথাগুলাে তিনি আরাে স্পষ্ট উচ্চারণে বলে দিতেন।
কিন্তু ট্রাকিওস্টমি করার ফলে আমার কথা বলার ক্ষমতা সম্পূর্ণ চলে গেলাে। কিছু দিন পর্যন্ত আমার ভাব প্রকাশ করার একমাত্র উপায় ছিলাে শব্দগুলাে এক-একটি অক্ষরের সাহায্যে বানান করে বলা। যখন কেউ বানান লেখা কার্ডে সঠিক অক্ষরটা দেখাতেন তখন আমি ভুরু তুলে সম্মতি জানাতাম। বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র তাে দূরের কথা, এ ভাবে কারাে সাথে কথা-বার্তাও বলা বেশ শক্ত ছিলাে। আমি দিনকে দিন এভাবে পার করতে লাগলাম। তবে ওয়াল্ট ওটোজ (Walt Woltosz) নামে ক্যালিফোর্নিয়ার এক কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ আমার দুরবস্থার কথা শুনেছিলেন। তিনি ইকোয়ালাইজার (Equalizer) নামে একটা কম্পিউটার প্রােগ্রাম লিখেছিলেন, সেটা তিনি আমাকে পাঠিয়ে দেন। এ যন্ত্রে আমার হাতের একটা সুইচ টিপলে পর্দায় অনেকগুলাে শব্দের তালিকা ভেসে ওঠে। তার থেকে যে কোনাে একটা শব্দ আমি বেছে নিতাম। যন্ত্রটা মাথা কিংবা চোখ নাড়িয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যেতাে। আমি কী বলতে চাইছি সেটা একবার ঠিক হলে সেটা বাক্য সংশ্লেষককে (Speech Synthesizer) পাঠিয়ে দিতে পারি ।
প্রথমে আমি ইকোয়ালাইজারটা.চালাতাম একটা ডেস্ক পট কম্পিউটারের উপরে। এর পরে কেব্রিজ অ্যাডাপ্টিভ কমিউনিকেশনস্-এর (Cambridge Adaptive Communications) ডেভিড মেসন (David Mason) আমার হুইল চেয়ারে একটা ব্যক্তিগত কম্পিউটার (Personal Computer) এবং একটা বাক্য সংশ্লেষক (Speech Synthesizer) লাগিয়ে দিলেন। এ যন্ত্রের সাহায্যে আমি আগের চেয়ে অনেক ভালাে ভাব প্রকাশ করতে পারি। মিনিটে প্রায় ১৫টা শব্দ ব্যবহার করতে পারি। আমি যা দেখছি সেটা হয় বলতে পারি কিংবা ডিস্কে (কম্পিউটারের চাকতি) জমিয়ে রাখতে পারি। তারপর আমি সেটাকে ছাপিয়ে নিতে পারি কিংবা সরল করে বাক্যের পর বাক্য বলতে পারি।
এ ব্যবস্থার সাহায্যে আমি দুটো বই লিখেছি আর কয়েকটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছি। সেগুলাে শ্রোতাদের পছন্দ হয়েছে। আমার মনে হয় এর একটা প্রধান কারণ স্পীচ্ প্লাস্ (Speech Plus)-এর তৈরি স্পীচ সিনথেসাইজারের গুণগত মান। মানুষের কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব খুবই বেশি। আপনার কথা যদি জড়ানাে হয় তাহলে লােকে ভাববে আপনি জড়বুদ্ধি। আমার ধারণা, আমি যতােগুলাে শুনেছি তার ভেতরে এটাই বােধ হয় সবচেয়ে ভালাে। এ যন্ত্রে উচ্চারিত শব্দের পরিবর্তন হয়—ডালেকের মতাে শােনায় না (Dalek হিব্রুর চতুর্থ অক্ষর)।
একমাত্র অসুবিধা হলাে আমার কথায় আমেরিকান টান এসে যায়। তবে এখন আমি নিজেকে ঐ স্বরের সাথে একাত্ম বােধ করি। আমাকে ব্রিটিশের মতাে কণ্ঠস্বর দিতে চাইলেও আমি আমার এখনকার স্বর বদলাতে রাজি হবাে না। তাহলে আমার মনে হবে আমি অন্য লােক হয়ে গেছি। আর তাই আমি তা হতে চাই না।
আরও পড়ুন,
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
এ কথা ঠিক যে, কার্যত আমি বয়ােপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই মােটর নিউরন ব্যাধিতে (Motor Neurone Disease) ভুগছি। কিন্তু সে রােগ-ভােগ আমাকে আকর্ষণীয় পরিবার গঠন করতে এবং কর্মে সাফল্য লাভ করতে বাধা দিতে পারে নি। এটা সম্ভব হয়েছে আমার স্ত্রী, আমার সন্তান এবং অন্য অনেক লােকের এবং সংগঠনের সাহায্যের জন্যে। আমার ভাগ্য খুব ভালাে, আমার অবস্থা ঐ অসুখের ক্ষেত্রে সাধারণত যতাে দ্রুত মন্দের দিকে যাওয়ার কথা ততাে দ্রুত মন্দ হয় নি। এ থেকে মনে হয় নিরাশ হওয়ার কোনাে প্রয়ােজন নেই। আমি তাই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। কেবল আগামির জন্য আমার ভাবনা।
Post a Comment