F বিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি - Fact Mohi
আজকে যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি গত একশাে বছর তার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে—এবং আগামি একশাে বছরে তার আরাে বেশি পরিবর্তন হওয়ার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকে এ পরিবর্তন বন্ধ করে অতীতে ফিরে যেতে চান। তাদের দৃষ্টিতে অতীতে যুগ ছিলাে শুদ্ধতর আর সরলতর। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই অতীতকালে এমন কিছু চমকপ্রদ ছিলাে না। সুবিধাভােগী একটা সংখ্যালঘু অংশের কাছে ব্যাপারটা তেমন মন্দ ছিলাে না। তবু তারা আধুনিক চিকিৎসা পেতেন না—মেয়েদের সন্তান জন্ম ছিলাে অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার। অথচ জনগণের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশের কাছে। জীবনটা ছিলাে নােংরা, পশুসুলভ এবং স্বল্পস্থায়ী। মানুষ যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাে।    মানুস হিসেবে আমাদের জ্ঞান আর কর্ম অবশ্যই সীমিত। তবে কেউ চাইলেও কালকে অতীত যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। জ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যা খুশি মতাে ভুলে যাওয়া যায় না। কেউ ভবিষ্যতের দিকে বৃহত্তর অগ্রগতি বন্ধ করতে পারে না। যদি গবেষণার জন্যে দেওয়া সমস্ত সরকারি অর্থদান বন্ধ করে দেওয়া হয় (আধুনিক সরকার এ কর্ম করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে) তাহলেও প্রতিযােগিতার শক্তিই প্রযুক্তি বিদ্যাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া অনুসন্ধিৎসু মনকে কেউ মূলগত বৈজ্ঞানিক চিন্তা থেকে বিরত করতে পারে না। সে চিন্তার জন্যে তাদের অর্থপ্রাপ্তি হােক বা না হােক তাতে কিছু আসে যায় না।    

 

 

বিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি - Fact Mohi

 

বিজ্ঞানের আরাে অগ্রগতি বন্ধ করার একমাত্র উপায় বিশ্বজোড়া এমন একটি একনায়কতন্ত্রের সরকার গঠন, যে সরকার যে কোনাে নতুন চিন্তা দমন করবে। তবে মানবিক উদ্যম এবং উদ্ভাবনী শক্তি এমনই যে এতেও কোনাে সাফল্য হবে না। এর ফলে কেবল পরিবর্তনের হার একটু কমতে পারে। এ ছাড়া আর কিছুই নয়।       আমরা যদি মেনে নিই যে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার দ্বারা আমাদের পৃথিবীর পরিবর্তন আমরা বন্ধ করতে পারি না, তাহলে অন্ততপক্ষে আমরা চেষ্টা করতে পারি পরিবর্তনের অভিমুখ সঠিক করতে। এর অর্থ হলাে, একটা গণতান্ত্রিক সমাজে জনসাধারণের বিজ্ঞান সম্পর্কে একটা মূলগত বােধ থাকা উচিত। তার ফলে তারা সঠিক সংবাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, বিশেষজ্ঞের হাতে সবটা ছেড়ে দেবে না। বর্তমানে জনসাধারণের বিজ্ঞান সম্পর্কে দুটো বিপরীতধর্মী ধারণা রয়েছে। একদিকে তারা চান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিদ্যার অগ্রগতি জীবনধারণের মানের যে উন্নয়ন করে চলছে সে উন্নয়নের হার অক্ষুন্ন থাকুক। আবার অন্যদিকে তারা বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করেন । তার কারণ বিজ্ঞান তারা বােঝেন না। পাগলের বৈজ্ঞানিক ল্যাবরেটরিতে একটা ফ্যাঙ্কেনস্টাইন্ তৈরি করার চেষ্টা করছে—এ রকম সব কার্টুনে সে অবিশ্বাস স্পষ্ট। গ্রীনৃপার্টিগুলাের সমর্থনের পেছনে এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু জনসাধারণের বিজ্ঞানে, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি বিরাট আকর্ষণ রয়েছে। এটা বােঝা যায় টেলিভিশনে কসমস কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকথার (Science Fiction) দর্শকদের বিরাট সংখ্যা দেখে। এটা আসলেই বিস্ময়কর।     

 

 

 

 

বিস্ময়কর এ আকর্ষণকে কী করে কাজে লাগানাে যায়? কী করে তাদের ভেতরে সত্য সংবাদের ভিত্তিতে অম্ল বৃষ্টি (Acid Rain), গ্রীন্ হাউস অভিক্রিয়া (Green House Effect), পারমাণিবক অস্ত্র (Nuclear Weapons), বশংগতি সম্পর্কীয় প্রযুক্তিবিদ্যা (Genetic Engineering) ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতাে বৈজ্ঞানিক পশ্চাৎপট সৃষ্টি করা যায়? স্পষ্টতই এর ভিত্তি করে হতে হবে স্কুলের শিক্ষা। কিন্তু স্কুলে বিজ্ঞানকে অনেক সময়ই নীরস আকর্ষণহীন রূপে উপস্থিত করা হয়। এটা যেনাে আসলেই কঠিন ও দুর্বোধ্য।  

 


 

ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা পাশ করার জন্যে মুখস্থ করে কিন্তু বিশ্বে তাদের চার পাশে সে বিদ্যার প্রাসঙ্গিকতা তারা বুঝতে পারে না। তা ছাড়া বিজ্ঞান অনেক সময়ই সমীকরণের সাহায্যে শেখানাে হয়। যদিও সমীকরণগুলাে গাণিতিক চিন্তন বােঝানাের সবচেয়ে নির্ভুল এবং সংক্ষিপ্ত উপায় তবুও অধিকাংশ লােকই সমীকরণ দেখলে ভয় পান। কিছু দিন আগে আমি সাধারণ মানুষের জন্যে একটা বৈজ্ঞানিক বই লিখেছি। তখন আমাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছিলাে যে, বইটিতে সমীকরণ থাকলে প্রতিটি সমীকরণের জন্যে বিক্রি অর্ধেক করে কমে যাবে। বইটাতে আমি একটাই সমীকরণ দিয়েছি—আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা E=Mc2। হয়তাে এ সমীকরণটা না থাকলে এর বিক্রি দ্বিগুণ হততা। মানুষের কি বৈচিত্র্য ভাবনা?    গবেষক বিজ্ঞানীরা আর ইঞ্জিনিয়ররা চেষ্টা করেন তাদের চিন্তাধারা সমীকরণের অবয়বে প্রকাশ করতে। তার কারণ তাদের প্রয়ােজন পরিমাণগত মূলগুলাে নির্ভুলভাবে জানা। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাগুলাে সম্পর্কে গুণগত ধারণাগুলােই যথেষ্ট। এ ধারণাগুলাে ভাষা এবং ছবির সাহায্যেই প্রকাশ করা যায়, সমীকরণ ব্যবহারের কোনাে প্রয়ােজন হয় না। সেটা কোনাে কাজে আসে না।    

 

 

আজকে আমাদের স্কুলে যে বিজ্ঞান শেখানাে হয় সেটা শুধু মূলগত কাঠামাে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির হার এখন এতাে দ্রুত যে, সবার ক্ষেত্রেই স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর থেকে বিজ্ঞানের নতুন নতুন বিকাশ হয়ে চলছে। স্কুলে থাকতে আমি কখনােই আণবিক জীববিদ্যা (Molecular Biology) কিংবা ট্রান্‌জিস্টার (Transistors) সম্পর্কে কিছু শিখি নি। কিন্তু বংশগতির ইঞ্জিনিয়ারিং (Genetic Engineering) এবং কম্পিউটার—এ দুটির বিকাশে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রা পরিবর্তন করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।    

 

 

একেবারে সাধারণের জন্যে লেখা বই এবং পত্র-পত্রিকায় লেখা বিজ্ঞান সম্পর্কীয় প্রবন্ধ বিজ্ঞানের নতুন বিকাশ প্রচার করতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্যে লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় বইয়ের পাঠকও জনসাধারণের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। কেবল টেলিভিশনই জনসাধারণের কাছে পৌঁছায়। টেলিভিশনে অনেক বিজ্ঞান বিষয়ক ভালাে কার্যক্রম (Programme) থাকে কিন্তু অন্য অনেক প্রােগ্রাম বৈজ্ঞানিক বিস্ময়কে যাদুর খেলার মতাে দেখানাে হয়। অথচ সেগুলাে ব্যাখ্যা করা হয় না কিংবা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার কাঠামাের সাথে তাদের কী রকম মিল সেটা দেখানাে হয় না। যারা টেলিভিশনের জন্যে বিজ্ঞানের প্রােগ্রাম তৈরি করেন তাদের বােঝা উচিত যে, জনসাধারণকে কেবল আনন্দ দেওয়াই তাদের কর্তব্য নয়—জনতাকে শিক্ষাদানও তাদের কর্তব্যের অঙ্গ। তাদেরকে এর মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে। সে শিক্ষা হবে সটিক ও বাস্তব সম্মত।    অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট কোনাে কোনাে বিষয়ে জনসাধারণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে? সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলাে পারমাণবিক অস্ত্র। খাদ্য সরবরাহ কিংবা গ্রীন হাউস অভিক্রিয়া ইত্যাদি সমস্যা ধীরগামী কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র কয়েক দিনের ভেতরেই এই পৃথিবী থেকে সমস্ত মনুষ্য জীবন চিরতরে ধ্বংস করতে পারে।    

 

 

ঠাণ্ডা যুদ্ধ (Cold War) শেষ হওয়ার ফলে পূর্ব-পশ্চিমের ভেতরকার উত্তেজনা অনেকটাই কমেছে। এর অর্থ হলাে পারমাণবিক অস্ত্রের ভীতি গণচেতনার পেছনের সারিতে স্থান নিয়েছে। কিন্তু যতাে দিন পর্যন্ত বিশ্বের সমস্ত মানুষকে হত্যা করার মতাে অস্ত্র রয়েছে ততত দিন পর্যন্ত বিপদও রয়েছে। আমাদের এ পৃথিবী এবং পৃথিবীবাসী কখনােই ঝুঁকিমুক্ত হয়। এমন কি ভীতিমুক্তও নয়।    

 

 

পূর্বতন সােভিয়েত রাষ্ট্রগুলােতে পারমাণবিক অস্ত্রগুলােকে উত্তর গােলার্ধের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নগরের দিকে তাক করে রাখা হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু করতে প্রয়ােজন শুধু কম্পিউটারের একটাতে ভুল কিংবা অস্ত্রগুলাে চালনা করার দায়িত্ব যাদের রয়েছে তাদের কয়েক জনের বিদ্রোহ। আর দুশ্চিন্তার বিষয় হলাে তুলনামূলকভাবে স্বল্পত সামরিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলােও পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করছে।    

 

 

 

বিশ্বের বৃহৎ শক্তিরা মােটামুটি যুক্তিপূর্ণ আচরণ করে এসেছে কিন্তু লিবিয়া কিংবা ইরাক, পাকিস্তান, এমন কি আজারবাইজানের মতাে রাষ্ট্র সম্পর্কে সে রকম বিশ্বাস থাকা সম্ভব নয়। কয়েকটা পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করছে। কয়েকটা পারমাণবিক অস্ত্র অদূর ভবিষ্যতে তাদের দখলে আসতে পারে। বিপদটা সেখানে নয়। কারণ তাদের অস্ত্রগুলাে হয়তাে বেশ পুরানাে ধরনের। হয়তাে তারা কয়েক মিলিয়ন নরহত্যাও করতে পারবে। আসলে বিপদটা হলাে দুটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রশক্তির ভেতর যুদ্ধ বৃহৎ শক্তিদের যুদ্ধে নামাতে পারে—সে শক্তিদের অস্ত্রসম্ভার অবশ্যই বিরাট।    

 

 

জনসাধারণের এটা বুঝতে পারা এবং অস্ত্রখাতে ব্যয় হ্রাস করার জন্যে সরকারের উপর চাপ দেওয়ার গুরুত্ব অনেক। পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ দূর করার হয়তাে কার্যক্ষেত্রে সম্ভব নয়, কিন্তু অস্ত্রের সংখ্যা হ্রাস করে আমরা বিপদটা আরাে অনেক কমাতে পারি।     

 

 আরও পড়ুন,

 

আমরা পারমাণবিক যুদ্ধ যদি এড়াতে পারি তবুও এমন অনেক বিপদ আছে যা আমাদের সবাইকে ধ্বংস করতে পারে। একটা বদ রসিকতা আছে; অন্য গ্রহের কোনাে সভ্যতা যে আমাদের সাথে যােগাযােগ করতে পারে নি। তার কারণ আমাদের স্তরে পৌঁছে তারা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। কিন্তু জনসাধারণের সদিচ্ছার উপর আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। হয়তাে এ রসিকতা আমরা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবাে। তবে তার জন্য দরকার আমাদের আন্তরিকতা এবং পৃথিবীকে ভালােবাসার মত মানসিকতা গড়ে তােলা।

Post a Comment

Previous Post Next Post