F মানুষ হতে পারিনি - শেষ পর্ব

ঢাকার এক নামকরা রেস্টুরেন্টে রাতের ডিনার সারতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবার এসেছে। স্বামী-স্ত্রী সহ তাদের দুই সন্তান রাজকীয় টেবিলে বসে আজ রাতের ডিনার সারছেন। এত বড় একটা টেবিলেও জায়গা হলাে না তাদের সাথে আসা এক গৃহকর্মীর। গৃহকর্মীর বয়স আনুমানিক আট কিংবা দশ। তার জায়গা হলাে দূরের একটা ছােট্ট চেয়ারে। সেখানে বসে থেকে বাচ্চাটা এক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আর হয়তাে এতদিনে সে বুঝে গিয়েছে। এসব ডিনার কিংবা রাজকীয় খাবারগুলাে তার জন্য নয়। বড়লােকের উচ্ছিষ্ট কিংবা পচা বাসি খাবারগুলােই তাদের আহার নিবারণের একমাত্র মাধ্যম।


মানুষ হতে পারিনি - শেষ পর্ব,মানুষ হতে পারিনি,ভালোবাসার গল্প,রোমান্টিক গল্প,জীবনের গল্প,Fact Mohi
মানুষ হতে পারিনি - শেষ পর্ব



ধানমন্ডির ঝিগাতলায় এক রিকশায় স্বামী-স্ত্রী-সন্তান আইসক্রিম খেতে খেতে যাচ্ছে। না আইসক্রিম খাওয়াটা দোষের কিছু না। কিন্তু সেই রিকশায় তাদের পায়ের নিচে গুটিশুটি করে বসে রয়েছে তাদের এক গৃহকর্মী। আফসােস সবার জায়গা হলেও জায়গা পেল না গৃহকর্মীটি।




উত্তরার এক নামকরা হাসপাতালে এক দম্পত্তি এসেছে। লােকটার বয়স চল্লিশ কিংবা তারও একটু বেশি হবে। আর পাশে থাকা মেয়েটার বয়স হবে সতেরাে কি আঠারাে। নিজস্ব প্রাইভেট কারে করে এসেছে। তখনও বিষয়টা স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ মেয়েটা কান্না শুরু করে দিল। একেবারে গড়াগড়ি করে কান্না। আমি বিষয়টা বুঝতে একটু এগিয়ে গিয়ে জানতে পারলাম। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট আর এই প্রেগন্যান্সির কারণ পাশে থাকা লােকটি। লােকটি কোনাে এক রাজনীতি দলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মেয়েটি তাদের বাসায় কাজ করে। মেয়েটি তার পেটের সন্তানটিকে রাখতে চাচ্ছে। সে দূরে 1 কোথাও চলে যাওয়ার আশ্বাসও দিচ্ছে। কিন্তু না তা কী করে হয়। লােকটা খুবই সম্মানীয় ব্যক্তি। সমাজে তার একটা বিশেষ পরিচিতি আছে। সে জনগণের সেবক। সবার আগে তার সম্মান। এরকম দুই-চারটা শিশু মেরে ফেললে তাতে কী আসে যায়?




আইএলওর গবেষণা বলছে, দেশে মােট গৃহকর্মীর ৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ বাসাবাড়িতে থেকে কাজ করে। আর ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ খণ্ডকালীন কাজ করে। গৃহকর্মীর কাজে নিয়ােজিত থাকেন মূলত নারীরাই, এটা ৯৭ শতাংশ। মাত্র ৩ শতাংশ পুরুষ গৃহকর্মী দেখা যায়, যাদের সবাই শিশু। গৃহকর্মীদের নির্ধারিত কোনাে কর্মঘণ্টা নেই। সাপ্তাহিক ছুটি বা অবসর নেই। এমনকি ঘুমানাের কোনাে নির্দিষ্ট স্থানও নেই। সামান্য ত্রুটিতে মারধর, ঠিকমতাে খাবার না দেওয়া, বেতন কম দেওয়া, বাড়িতে যেতে না দেওয়ার অভিযােগ তাে আছেই।


আরও পড়ুন,
গল্পটা মিথ্যে নয় - সকল পর্ব 
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব 
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার 
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT


আইএলও তাদের গবেষণায় আরও বলছে, বাড়িতে পূর্ণকালীন কাজে থাকা গৃহকর্মীদের ৪৮ শতাংশই নিদারুণভাবে মৌখিক নির্যাতনের শিকার হয়, ২৫ দশমিক ৯ শতাংশের ওপর চলে চরম মানসিক নির্যাতন। এ ছাড়া ১২ দশমিক ৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার। ৩ শতাংশ গৃহকর্মী যৌন নির্যাতনের কথা বলেন। প্রায় ৬৬ শতাংশ গৃহকর্মী জানান, রাতের ঘুমানাের সময় নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না তারা।




এই হিসাব কয়েকটি নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা, কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেক ভয়াবহ। কারণ অনেক নির্যাতনের ঘটনায় অর্থ ও চাপের মুখে সমঝােতা করা হয়। গৃহকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা দরিদ্র হওয়ায় তারা মামলা-মােকাদ্দমায় যেতে চান না বা যেতে সাহস পান । প্রভাবশালীরা অনেক নির্যাতনের ঘটনাই ধামাচাপা দিয়ে ফেলেন।





এবার প্রশ্ন করুণ নিজেকে :


যদি আপনাকে বলা হয়, চোখ বন্ধ করে একবার আপনার নিজের আশেপাশের প্রতিবেশী কিংবা আপনার নিকটাত্মীয়দের দিকে একবার চিন্তা করে দেখুন তাে, কেউ কি আছে এমন, যারা তাদের গৃহকর্মীকে এরকম নির্যাতন করে। সত্যি বলতে আপনার মনে তৎক্ষণাত এমন দুই-চারটি পরিবার ভেসে উঠেছে যারা তাদের গৃহকর্মীকে নিজেদের দাস-দাসী হিসেবে রেখেছে। কিন্তু মজার বিষয় হলাে আপনি কখনােই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন না। তারা সম্মানীয় ব্যক্তি কিংবা উচ্চপর্যায়ের লােকজন। আপনি এমন কয়টা অপরাধের শাস্তি হতে দেখেছেন? একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তাে গৃহকর্মী নির্যাতনের জন্য কয়জন সাজা পেয়েছেন। আপনার ঘণ্টা চারেক লেগে যাবে একটা বের করতে। সাজা তাে অনেক পরের বিষয় থানা পর্যন্ত গিয়েছে এমন সংখ্যাই বা কত? কী করে যাবে, কে তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ করবে? তারা সমাজের সুশীল ব্যক্তি। তারা সমাজের মাথা, সমাজ নিয়ন্ত্রণ তাে তারাই করে, তারা দ্রলােক।




আমরা অনেক শিক্ষিত। গলায় টাই, গায়ে সুট-কোট পরে ঘুরে বেড়াই আর লােকাল বাসের হেল্পারকে তার মা-বাবা তুলে গালি দেই। রিকশাওয়ালা পাঁচ টাকা বেশি চাওয়াতে তাদের কলার ধরে রক্তাক্ত করে দেই। নিজের স্ত্রী, সন্তানদের রাজকীয় পােশাক কিংবা খাবার পরিবেশন করি আর ঘরে থাকা কাজের ছেলে কিংবা মেয়েটার কথা আমাদের ভাবনাতেও রাখি না। পারি না হাসিমুখে এদের সাথে একটু কথা বলতেও।




তারপরও আমরা শিক্ষিত আমরা ডিগ্রিধারী। আমাদের অনেক বড় বড় টাইটেল। জীবনে অনেক কিছু অর্জন করে ফেলেছি কিন্তু আফসােস পারিনি এখন পর্যন্ত নিজের মনুষ্যত্ববাধটাকে জাগিয়ে তুলতে।




“ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি, একি জলেই সব হয় গাে শুচি, দেখে শুনে হয় না রুচি যমে তাে কাউকেই ছাড়বে না।”(বাণীতে - লালন শাহ)

Post a Comment

Previous Post Next Post