আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম বাবু তােমার নাম কী? মৃদু স্বরে বলল মানিক। এর মধ্যেই একজন নার্স এসেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করছে আপনি কি এই বাচ্চার কেউ? জি না, আচ্ছা এই বাচ্চাটার কী হয়েছে? নার্স বললেন গরিবের কখনােই কিছু হয় না ম্যাডাম। এই বাচ্চাটা সাহেবের বাসায় কাম করে। এতিম বাচ্চা, গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে জজ সাহেব। শুধু এবার না দুই-তিন মাস পরপরই এই ছেলেটা হাসপাতালে ভর্তি থাকে, চার-পাঁচ দিন করে। তবে আর মনে হয় ভর্তি করাতে হবে না।
মানুষ হতে পারিনি - দ্বিতীয় পর্ব |
আমি বললাম কেন? বাচ্চাটার শরীরের অবস্থা ভালাে না। আসার পর থেকে স্যালাইন দিয়ে রেখেছি। ছেলেটার হার্টে ছিদ্র ধরা পড়েছে। বড় বড় দুটো ছিদ্র হয়ে গেছে। চিকিৎসা করতে অনেক টাকা লাগবে। জজ সাহেব বলল স্যালাইন দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। ছেলেটাকে একটিবার দেখতেও আসে না পাষণ্ড কোথাকার। আচ্ছা সবাই সব জেনেও চুপ করে আছে কেন? কে করবে প্রতিবাদ, আপনি করবেন?
আপনি কার কাছে বিচার দেবেন, বিচার তাে তারাই করে। এরা রক্ষক নয়। ভক্ষক। আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম কী মায়া ভরা মুখ জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
এবার ছেলেটার হাসপাতালে আসার কারণ হলাে সে তার সাহেবের সিগারেটটি ধরিয়ে আনতে দেরি করেছিল। ব্যাস সম্পূর্ণ সিগারেটটি বাচ্চাটার বুকে ধরিয়ে ধরিয়ে শেষ করল। ছেলেটার বুক জুড়ে পােড়া দাগ। এখনও শুকায়নি। চামড়া পুড়ে বড় হয়ে ঘা হয়ে গিয়েছে। আমি সহ্য করতে পারিনি। ছােট্ট একটা ছেলে কী করে এতটা কষ্ট সহ্য করছে।
ছেলেটার মুখে শুনলাম তাকে প্রায়ই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হতাে। আর লাঠি দিয়ে আঘাত করত। তার দুটি হাতই ভাঙা, গায়ে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। শুধু যে জজ সাহেব একাই মারতাে তা কিন্তু না। জজ সাহেবের স্ত্রী, সন্তানরা সুযােগ পেলেই নির্যাতন করত বাচ্চাটাকে। ঘরের সমস্ত কাজ বাচ্চাটাকে দিয়ে করাত। থালা-বাটি পরিষ্কার থেকে কাপড় ধােয়া সব কাজই করে দিত মানিক। বিনিময়ে পেত অসংখ্য অমানবিক নির্যাতন।
আমি মানিককে জিজ্ঞেস করলাম বাবু তােমার জন্য কী আনব? তুমি কী খাবা সে আমাকে বলল পােলাও আর মাংস। আচ্ছা বাবু কালকেই তােমার জন্য পােলাও আর মাংস রান্না করে নিয়ে আসব।
আরও পড়ুন,
গল্পটা মিথ্যে নয় - সকল পর্ব
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
ডাক্তারের সাথে কথ বলে জানলাম, ছেলেটা যেকোনাে সময় মারা যেতে পারে। বাচ্চা ছেলে অতিরিক্ত ভয়ে হার্টে ফুটো হয়ে গিয়েছে। ছেলেটার লাঞ্চেও পানি চলে এসেছে। আমি চলে এলাম বাড়িতে। মা-কে সব খুলে বললাম। মানুষ কতটা পাষণ্ড হতে পারে তা সেদিন টের পেলাম। পরদিন সকালে পােলাও আর মাংস রান্না করে মা আর আমি চললাম হাসপাতালে। গিয়ে দেখলাম বেডে কেউ নেই। আমি নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম বাচ্চাটা কোথায়? জবাবে নার্সটা কাঁদতে শুরু করল আর বলল গতকাল রাতে পােলাও-মাংস খাবে বলে খুব কান্না করল বাচ্চাটা। আমি নিচ থেকে পােলাও-মাংস কিনে আনতে পাঠালাম। আর নিয়ে আসতে আসতে ছেলেটা মরে গেল। আমি হাত থেকে টিফিন বক্সটা ছেড়ে দিলাম । আর বসে পড়লাম মেঝেতে আমার মাথা ঘুরছে, দুচোখে কেমন জানি অন্ধকার দেখছি। দুচোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরছে। ছেলেটাকে শেষ দেখাটা দেখার জন্য দৌড়ে গেলাম প্রতিবেশীর বাসায়, গিয়ে দেখলাম সেখানে তালা ঝুলানাে। পাশের ফ্ল্যাট থেকে বলল তাদের কাজের ছেলেটার জ্বর হয়ে মারা গিয়েছে। লাশ নিয়ে তারা তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে। শেষ দেখাটাও দেখতে পারলাম না। পারলাম না মানিকের শেষ ইচ্ছেটাও রাখতে। গরিব হয়ে জন্মানােটা যে কত বড় পাপ তা বুঝলাম সেদিন।
“ধনীরা যে মানুষ হয় না, তার কারণ ওরা কখনাে নিজের অন্তরে যায় না। দুঃখ পেলে ওরা ব্যাংকক যায়, আনন্দে ওরা আমেরিকা যায়। কখনাে ওরা নিজের অন্তরে যেতে পারে না, কেননা অন্তরে কোনাে বিমান যায় না।” (বাণী- হুমায়ন আহমেদ)
Post a Comment