আমাদের বাড়িটা খারাপ ছিলাে না। আমাদের জন্য বেশ মানানসই। কেননা উচু এবং সরু একটা ভিক্টোরিয়ান যুগের বাড়িতে আমরা বসবাস করতাম। বাবা যুদ্ধের সময় বাড়িটা খুব সস্তায় কিনেছিলেন। তখন সবাই ভেবেছে লন্ডনকে বােমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হবে। এমন কি একটা V-2 রকেট আমাদের বাড়ি থেকে কয়েকটা বাড়ি দূরে গিয়ে পড়েছিলাে। আমি তখন আমার মা এবং বােনের সাথে বাইরে ছিলাম কিন্তু বাবা বাড়িতে ছিলেন। কপাল গুণে তেমন তার কোনাে চোট লাগে নি, বাড়িটারও বিশেষ কোনাে ক্ষতি হয় নি। কিন্তু রাস্তায় একটু দূরে কয়েক বছর ধরে বােমা পড়া জায়গাটা ছিলাে। সেখানে আমি আর আমার বন্ধু হাওয়ার্ড বিভিন্ন সময় খেলা করতাম, দৌড়াতাম। সে থাকতে রাস্তার অন্যদিকে তিনখানা বাড়ি পরে।
স্টিফেন হকিং এর জন্ম ও শৈশব - দ্বিতীয় পর্ব |
হাওয়ার্ড যেনাে আমার কাছে রহস্য উন্মােচন করেছিলাে। আমার চেনা অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের বাবা-মায়ের মতাে হাওয়ার্ডের বাবা-মা কোনাে বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। ও বায়রন হাউস স্কুলে যেনাে না—যেতাে সরকারি স্কুলে (Council School)। সে খুব ফুটবল আর বক্সিং খেলা জানতাে। আমার বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের ঐ ধরনের খেলার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। তাদের জগৎ আর আমাদের জগৎ ছিলাে একেবারে আলাদা! দু জন একেবারে দুই প্রান্তে।
আমার সেই জীবনের প্রথম দিকের আর একটা স্মৃতি—আমার প্রথম খেলনা রেলগাড়ির সেট পাওয়ার। যুদ্ধের সময় খেলনা তৈরি হতাে না—অন্তত দেশের জন্যে তাে নয়ই। কিন্তু খেলনা রেলগাড়িতে আমার আকর্ষণ ছিলাে অনেক। বাবা আমাকে একটা কাঠের রেলগাড়ি বানিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আমি তাতে খুশি হই নি। আমি এমন গাড়ি চেয়েছিলাম যেটা চলে। তাইতাে বাবা একটা পুরানাে স্প্রিং-য়ের রেলগাড়ি (Clockwork Train) কিনে লােহা দিয়ে ঝালাই করে আমাকে বড় দিনে দিয়েছিলেন। তখন আমার বয়স মাত্র ৩ বছর। সে রেলগাড়িটাও তেমন ভালাে হয় নি।
যুদ্ধের পরপরই বাবা আমেরিকা গিয়েছিলেন, 'কুইন মেরি’ (Queen Marry) জাহাজে ফেরার সময় মায়ের জন্যে কিছু নাইলন কিনে এনেছিলেন। তখন ব্রিটেনে নাইলন পাওয়া যেতাে না। বােনের জন্যে কিনে এনেছিলেন একটা সুন্দর পুতুল। সেটাকে শুইয়ে দিলে চোখ বন্ধ করতাে। আর আমার জন্যে তিনি এনেছিলেন একটা আমেরিকান রেলগাড়ি। সেটাতে গরু ধরার ফাঁদ ছিলাে। এমন কি ইংরেজি সংখ্যা আটের আকারে রেল লাইনও ছিলাে। বাক্সটা খুলে আমার যে উত্তেজনা হয়েছিলাে সেটা এখনাে মনে পড়ে।
প্রি-এর রেলগাড়িগুলাে ভালােই ছিলাে কিন্তু আসলে আমি চেয়েছিলাম ইলেকট্রিক ট্রেন। হাইগেটের কাছে ক্রাউফ্ এন্ড (Crouch End)-এ একটা রেলওয়ে ক্লাবের প্রতিরূপে ইলকট্রিক ট্রেনের নকশা দেখতে দেখতে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম। শেষ পর্যন্ত যখন বাবা-মা দু জনেই কোথায় যেনাে গিয়েছিলেন, তখন আমি পােস্ট অফিসের ব্যাংকে সামান্য যে কটা টাকা ছিলাে তাই তুলে নিয়ে একটা ইলেকট্রিক ট্রেনের সেট কিনে ফেললাম। টাকাগুলাে আমি উপহার পেয়েছিলাম ক্রিনিং (Christening)-এর মতাে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ দিনে। এগুলাে জমা করে রেখেছিলাম।
কিন্তু তাতেও হতাশ হলাম, কেননা এ গাড়িটা ভালাে হয় নি। আজকাল আমরা ক্রেতাদের অধিকার সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। আমার উচিত ছিলাে দোকানদার কিংবা যারা বানিয়েছে তাদের কাছে গিয়ে ঐ সেটটা ফেরত দিয়ে তার বদলে নতুন সেট দাবি করা। কিন্তু তখনকার দৃষ্টিভঙ্গি ছিলাে কিছু কেনা, মানে একটা সুবিধা পাওয়া। সেটার যদি দোষ থাকে তাহলে আপনার কপালটা খারাপ। বিক্রেতার কিছুই করার নেই ।
আর তাই আমি দুঃখ নিয়ে ইঞ্জিনের ইলেকট্রিক মােটরটা মেরামত করার জন্যে একটা দিলাম কিন্তু সেটা কখনােই ভালাে কাজ করে নি। পরে বয়স যখন তেরাে থেকে উনিশের মধ্যে তখন আমি এরােপ্লেন আর জাহাজের প্রতিরূপ (Model) বানিয়েছি। হাতের কাজে আমি কোনাে দিনই ভালাে ছিলাম না। তবে কাজটা আমি করেছিলাম আমার স্কুলের বন্ধু জন ম্যাক্লেনাহান্ (John Macclenahan)-এর সাথে। ও কাজটা অনেক ভালাে করতাে। বাড়িতে তার বাবার একটা কারখানা ছিলাে। আমি সব সময়ই চাইতাম এমন একটা প্রতিরূপ (Model) গড়তে যেটা কাজ করে এবং আমি সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সেটা দেখতে কী রকম তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম না।
আমার মনে হয় এ উদ্দেশ্যে আমি আর আমার স্কুলের আর এক বন্ধু রজার ফার্নেহাউ (Roger Rerneyhough) দু জনে মিলে অনেকগুলাে জটিল খেলা আবিষ্কার করেছিলাম। এ রকম একটা খেলা ছিলাে কারখানার উৎপাদন নিয়ে। সেটাতে ফ্যাক্টরি ছিলাে। সে ফ্যাক্টরিতে নানা রঙের একক (Unit) ছিলাে, রাস্তা ছিলাে, রেল লাইন ছিলাে। সেই রাস্তার রেল লাইনে মাল যাতায়াত করতাে, এমন কি একটা শেয়ার মার্কেটও ছিলাে। যুদ্ধের খেলা ছিলাে। সে খেলার বাের্ডটাতে চার হাজার চৌকোণা খুপরি (Square) ছিলাে। একটা সামন্ততান্ত্রিক খেলা ছিলাে—সে খেলায় প্রত্যেক খেলােয়াড়ের একটা বংশ থাকতাে আর থাকতাে সম্পূর্ণ একটা বংশপঞ্জি।
গল্পটা মিথ্যে নয় - সকল পর্ব
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
আমার মনে হয় এইতাে সমস্ত খেলা এবং রেলগাড়ি, জাহাজ আর এরােপ্লেনের খেলার উৎস ছিলাে একটাই। সে উৎস ছিলাে এগুলাের কর্মপদ্ধতি জানা আর সেগুলােকে কী করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটা জানা। পি.এইচ.ডি. (Ph.D.) শুরু করার পর এ দরকার মিটিয়েছে আমার মহাবিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কীয় গবেষণা। মহাবিশ্বের কর্মপদ্ধতি যদি আপনার জানা থাকে তাহলে এক অর্থে সেটাকে আপনি নিয়ন্ত্রণও করতে পারেন। এতে আপনার মনের আশা অনেকাংশে পূরণ হবে।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের কথা।
আমার বাবার কর্মস্থল হাইগেটের কাছে হ্যাম্পস্টেড (Hampstead) থেকে লন্ডনের * উত্তর পাশে শিল্ হিলে (Mill Hill) নব নির্মিত ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চ-এ (National Institute for Medical Research) চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণার জন্যে জাতীয় প্রতিষ্ঠান) স্থানান্তরিত হয়। তার মনে হয়েছিলাে হাইগেট থেকে বাইরে যাতায়াত করার চেয়ে লন্ডনের বাইরে থেকে শহরে যাতায়াত অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ।
সে জন্য আমার বাবা-মা সেন্ট অ্যালবাগ-এর ক্যাথেড্র টাউনে (Cathedral City of St. Albans) একটা বাড়ি কেনেন। জায়গাটা ছিলাে লন্ডনের ২০ মাইল উত্তরে আর মিস্ হিল থেকে ১০ মাইল উত্তরে। সেটা ছিলাে বেশ বড় ভিক্টোরীয় স্টাইলের জমকালাে আর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাড়ি। এক কথায় অনেক সুন্দর বাড়ি। বাড়িটা কেনার সময় বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালাে ছিলাে না। বাসযােগ্য করতে হলে বাড়িটাতে অনেক কাজ করার ছিলাে। কিছু কিছু জায়গা অপ্রয়ােজনীয় জিনিস পড়েছিলাে।
আর তাই আমার বাবা আর টাকা খরচ করতে রাজি হলেন না। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন ইয়র্কশায়ারের অন্যান্য লােকেরই মতাে। তার বদলে তিনি বাড়িটাকে চালু রাখতে চেষ্টা করতেন আর রঙ করতেন। কিন্তু বাড়িটা ছিলাে বেশ বড় আর বাবাও এ সমস্ত কাজে খুব অভিজ্ঞ ছিলেন না। তবে পাকা-পােক্ত গঠন ছিলাে বাড়িটার। সুতরাং এ অযত্নে তেমন কিছু ক্ষতি হয় নি।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বাবা খুব অসুস্থ হন (তার মৃত্যু হয় ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে)। বাবা-মা ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দেই বাড়িটা বিক্রি করেছেন। বাড়িটা আমি কিছুদিন আগে দেখেছি। মনে হয় নি বাড়িটাতে আর বেশি কিছু কাজ করা হয়েছে। কিন্তু দেখে মনে হলাে বাড়িটা এক রকমই আছে। এটার দিকে তাকালে আমার হৃদয়পটে অনেক স্মৃতি ভেসে ওঠে।
অবশ্য গৃহকর্মী রাখে এ রকম একটা পরিবারের জন্যে বাড়িটার পরিকল্পনা করা হয়েছিলাে। ভাড়ার ঘরে একটা নির্দেশক ফলক ছিলাে—সেটা নির্দেশ করত কোন্ ঘর থেকে ঘণ্টা বাজানাে হচ্ছে। আমাদের কোনাে গৃহকর্মী অবশ্য ছিলাে না। কিন্তু আমার প্রথম শােবার ঘরটা ছিলাে ইংরেজি L অক্ষরের একটা ছােট ঘর। ঐ ঘরটা আমি চেয়েছিলাম আমার খালাতাে বোেন সারা (Sarah)-র কথায়। সে আমার চেয়ে একটু বড়াে। সারা সম্পর্কে আমার খুব উচ্চ ধারণা হলাে। সে বলেছিলাে, ঐ ঘরে খুব মজা কতে পারবে। ও ঘরটার একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিলাে, ঐ ঘরের জানালা থেকে মাইকেলের ঘরের ছাদে উঠে জমিতে নেমে যাওয়া যেতাে। আর তাই এটা আমার খুব পছন্দ ছিলাে।
Post a Comment