F স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - চতুর্থ পর্ব

ফেসবুক লাইভে


আমি এখন ফেসবুক লাইভে। আজ আপনাদের নিকট কিছু প্রশ্নের উত্তর চাইতে এসেছি। জানি না আপনারা আমার মতাে একটা কুৎসিত হিজড়ার কথা শুনবেন কি না। তবুও বলছি, আচ্ছা আমার হিজড়া হওয়ার পিছনে কি আমার কোনাে হাত ছিল? আর হিজড়া হওয়াটা কি আমার অপরাধ? যদি এতে আমাদের কোনাে হাত না-ই থাকে তাহলে আপনাদের মতাে সুশীল সমাজের শিক্ষিত মানুষজন কেন আমাদের মেনে নিতে পারেন না। কেন আমাদের একটু হাসিমুখে বাঁচতে দেন না। কেন আমরা রাস্তায় বের হলে আপনাদের অবহেলা, গালি, অপবাদ দেওয়া এমনকি আপনাদের হাতে ধর্ষণ পর্যন্ত হতে হয়? আপনারা আমাদের জন্য কী করেছেন? আমাদের জন্য কোনাে চাকরি নেই, আমাদের জন্য কোনাে স্কুল নেই, আমাদের জন্য আলাদা কোনাে হাসপাতাল নেই। আমরাও তাে মানুষ, আমাদের কি এসবের প্রয়ােজন হয় না। যখন আমরা আমাদের প্রয়ােজনে আপনাদের সংস্পর্শে যাই তখন আপনারা আমাদের নিয়ে মজা করেন।



স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - চতুর্থ পর্ব,স্বপ্না থেকে স্বপ্না,রোমান্টিক গল্প,কষ্টের গল্প,ভাইরাল গল্প,ভালোবাসার গল্প,Fact Mohi




আপনারা আমাদের দুর্বলতার সুযােগ নেন। আপনাদের মতে আমরা মানুষদের হয়রানি করি। আসলেই কি আমরা আপনাদের হয়রানি করতে | চাই, একবারও কি তা আপনারা ভেবে দেখেছেন। বেঁচে থাকার জন্য আমাদেরকেও তাে দুবেলা দু-মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। আপনাদের নিকট আমরা হাত বাড়ালে আপনারা খুশি হয়ে আমাদের দু-টাকা দান করতে চান না। কী করব আমরা।




আমরা যদি পড়াশুনা শিখতে স্কুলে যাই সেই স্কুল থেকে আমাদের বের করে দেওয়া হয়। আপনারা আপনাদের বাচ্চাদেরকে স্কুল থেকে নিয়ে আসেন। যে স্কুলে হিজড়া পড়ে সেখানে আপনি আপনার অতি আদরের সন্তানটাকে পড়াতে চান না। তাহলে আমরা কই যাব। আমরা কীভাবে পড়াশুনা শিখব? আমাদের জন্য সরকার কেন একটা ব্যবস্থা করে দেয় না। কেন আমাদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় না? আমরা কোথাও চাকরির সুযােগ পাই না। কারণ আমরা হিজড়া। আচ্ছা সবকিছু থেকে আমরা বঞ্চিত তাহলে আমরা করবটা কী?




লাইভে প্রায় দুই হাজার মানুষ চলে এসেছে। অনেকেই জানতে চাচ্ছেন কেন আমরা নবজাতক শিশুর বাড়িতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা করি? আপনাদের পরিবারে যখন একজন নতুন মানুষের আগমন ঘটে তখন আপনাদের মতাে খুশি আর কেউ থাকে না। আমরা আপনাদের এই খুশির একটু ভাগ নিতে চাই। আমাদের জীবনে এমন কিছুই নেই নিয়ে আমরা একটু আনন্দ করব। তাই আপনাদের এই খুশিতে আমরা আপনাদের কাছ থেকে কিছু টাকা দাবি করি। আমরা সবার বাড়ি যাই না। যাদের কাছে এই সামান্য টাকাটা কোনাে বিষয় নয় আমরা তাদের কাছেই চেয়ে থাকি। এই একটাই উপলক্ষ্যে আমরা আপনাদের কাছ থেকে কিছু অর্থ পেয়ে থাকি। কিন্তু কেউই আমাদের কিছুই দিতে চায় না। আমাদের বেঁচে থাকার তাগিদে আমরা এসব করি। কী করব বলেন আমরা তাে অসহায়। আরও একজন প্রশ্ন করেছেন আমার চুল কোথায়?




আমার চুল ছিল, খুব সুন্দর চুল ছিল আমার। আজকে আমার শাস্তিস্বরূপ আমার চুল কেটে দেওয়া হয়েছে, আমাকে জুতাের মালা পরিয়ে আমার পিঠে একশ বেতের বাড়ি মেরে আমাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমার অপরাধ হলাে আমি বাচ্চা চুরি করেছি। >




অনিক নামের একজন বলেছেন তােরে জিন্দা কবর দেওয়া দরকার ছিল, তুই বাচ্চা চুরি কইরা এখন ফেসবুক লাইভ করছ।...(গালি) 




হ্যা ভাই আমি বাচ্চা চুরি করেছিলাম কিন্তু যাকে চুরি করেছিলাম সেও আমার মতােই একজন হিজড়া। সুশীল সমাজ তাকে কোনােভাবেই গ্রহণ করবে না। বাচ্চাটাকে তারা গৃহবন্ধি করে রাখে। নির্মম অত্যাচার করে। ' বাচ্চাটা মেয়ে সাজতে চায় কিন্তু তার পরিবার তাকে জোর করে পুরুষ বানানাে চেষ্টা চালাচ্ছে। এইবার আপনারাই বলেন আপনারা আশ্রয় দেবেন তাকে? সে যখন বড় হতে থাকবে তখন কী করবে তার পরিবার। আরও একটা অবাক করা খবর দেই বাচ্চাটার বাবা আমাকে গােপনে বলেছে, যেন আমি তার এই সন্তানটাকে চুরি করে নিয়ে আসি। কিন্তু নিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের মানুষ দেখে ফেলে। আর এর পরিণতি তাে আপনারা দেখতেই পারছেন।




একজন প্রশ্ন করেছেন যেহেতু বাচ্চার পরিবার রাজি ছিল তাহলে চুরি করতে হবে কেন? একটা সন্তান যেমনই হােক তার মা তাকে কখনােই ফেলে দিতে চায় না। পরিবারটির সবাই চাইলেও মা বিষয়টিকে মেনে নিতে পারত না। । তাই গােপন রাখতে চেয়েছিল তার বাবা। আর এর ফলাফল আমাকে ভােগ করতে হয়েছে।




একজন কমেন্টস করেছেন, আপনারা সত্তাবে উপার্জন করতে পারেন না? জি ভাই পারি একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন ভাই আপনি? এই সমাজে হিজড়াদের কোনাে ব্যবস্থা কি আছে ভাই?




এতক্ষণে পাঁচ হাজার মানুষ লাইভে চলে এসেছে অনেকেই অনেক প্রশ্ন করছেন। আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর আমার মতাে করে দেওয়ার চেষ্টা করছি।




প্রশ্ন- ০১. আপনি পরিবার থেকে আলাদা হলেন কীভাবে? (রাহাত)


উত্তর : আমার ছােটবেলা থেকেই মেয়েদের মতাে করে সাজতে ইচ্ছে করত। কিন্তু আমার বাবা চাইত আমি ছেলে হয়ে থাকি। কিন্তু আমাকে তাে আল্লাহ ছেলের মতাে করে বানায়নি। আমি কীভাবে ছেলে হবাে। যখন সবার আড়ালে গিয়ে আমি মেয়ে সাজতাম আমার বাবা তখন তা খুব সহজভাবে নিত না। আমাদের পরিবারে কেউ বেড়াতে আসলে কিংবা কোনাে অনুষ্ঠান থাকলে আমাকে টয়লেটে বন্দি করে রাখত। তাই একদিন আমি এক হিজড়ার সাথে পালিয়ে চলে আসি।


প্রশ্ন-০২. কোনাে বাসায় নতুন কোনাে শিশুর জন্ম হলাে কি না, তা আপনারা কীভাবে জেনে থাকেন? (পলাশ) 



উত্তর : আমরা যখন একটি এলাকায় ঘােরাফেরা করি তখন সেই এলাকার ছােট্ট বাচ্চাগুলাে আমাদের পিছু নেয় তখন আমরা তাদের জিজ্ঞেস করি আচ্ছা বাবু এই এলাকায় কোনাে শিশুর জন্ম হইছে কি না। তখন তারাই আমাদের বলে দেয়।





প্রশ্ন-০৩. পরিবার থেকে কি কোনাে খোঁজখবর নেওয়া হতাে? (অবুজ বালক)


উত্তর : যখন একটা হিজড়া শিশু একটি পরিবার থেকে চলে যায় তখন সব থেকে বেশি খুশি হয় তার বাবা। খোঁজ কখনাে নেয়নি। তবে আমার মাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করলে আমি লুকিয়ে মা-কে দেখতে যেতাম। কিন্তু বাবা দেখে ফেললে মা-কে সহ মাইর দিত। তবে মার সাথে মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হয়। ।




প্রশ্ন-০৪, আপনারা টাকা নেওয়ার জন্য মানুষদের সাথে কেন খারাপ আচরণ করেন? আর এভাবে হাতে তালি দেন কেন? (রাফি)



উত্তর : হাতে তালি দেওয়াটা আমাদের সম্প্রদায়ের একটা ঐতিহ্য। আর আমরা খারাপ আচরণ করতে চাই না। মানুষের কাছে আমরা টাকা চাইলে আমাদের সহজে তা দিতে চায় না। তখন আমাদের বাধ্য হয়ে এমন কিছু করতে হয়, যেন ভয় কিংবা সম্মানের কথা চিন্তা করে দশটি টাকা আমাদের দিয়ে দেয়।





প্রশ্ন ০৫. কাপড় খুলে ফেলা, উলঙ্গ হয়ে যাওয়া, নাচা, তালি দেওয়া এগুলাে কীভাবে দেখেন? (মেঘ বৃষ্টির আলাপন)


উত্তর : মানুষের মধ্যে যেমন ভালাে-খারাপ আছে, তেমনি আমাদের মধ্যেও ভালাে-খারাপ রয়েছে। খারাপ কাজগুলাে অবশ্যই খারাপ। তবে নাচা আর তালি দেওয়া আমাদের ভালাে লাগা।





প্রশ্ন-০৬, সরকার যদি আপনাদের কর্মসংস্থান করে দেয় তাহলে কি আপনারা এসব ছেড়ে দেবেন? (ইমন)


উত্তর : আমাদের সরকার কখনােই কিছু করে দেবে না। আর করে দিলেও আপনাদের মতাে সুশীল সমাজের লােকজন আমাদের মেনে নিতে পারবেন না। যদি আমাদের কর্মসংস্থান হয় তাহলে আমরা রাস্তায় কেন নামব বলেন? 




প্রশ্ন-০৭. আপনার বয়স হলে আপনাকে বা আপনাদেরকে, কে বা কারা দেখবে? (আদিল)


উত্তর :  আমাদের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের গুরুমা যাদের বয়স বেশি হয়ে যায় বা যখন আমিও গুরুমা হবাে তখন নতুন কম বয়সি হিজড়াদের ইনকাম করা টাকা দিয়ে আমরা চলব। আর নতুন হিজড়াদের দেখাশুনার দায়িত্ব থাকে গুরুমায়ের উপর।




প্রশ্ন-০৮. এখন অনেকেই হিজড়া সেজে টাকা তুলে চাঁদাবাজি করে এদের জন্যই আপনাদের বদনাম হচ্ছে- এরাই আপনাদের সমাজের চোখে আরও খারাপ করেছে। (রিয়া)


উত্তর : সত্যিকারের হিজড়ারা কখনােই বড় অপরাধ করে না। যারা হিজড়া সেজে টাকা তােলে এদের উদ্দেশ্যই থাকে খারাপ। কিন্তু বদনাম হয় আমাদের। বর্তমানে অনেক পুরুষই তাদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলে হিজড়া হচ্ছে। এদের উদ্দেশ্যই থাকে খারাপ— এরা বড় বড় অপরাধগুলাে করে।




প্রশ্ন-০৯. সমাজ আপনাদের যা দিচ্ছে, আর আপনারা যা করছেন তা কি খুব বেশিই অসংগতিপূর্ণ? (লিখন)


উত্তর : ভাই লিখন, আপনি কি প্রশ্নটা আমাকে করেছেন, না এই সুশীল সমাজের কাছে। তাই এই প্রশ্নটা আপনার কাছে আমারও রইল।


আরও পড়ুন,
গল্পটা মিথ্যে নয় - সকল পর্ব 
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব 
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার 
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT



প্রশ্ন-১০. আপনার আজকের এই পরিণতি তাে ভবিষ্যতে আরও অসংখ্য হিজড়ার সাথেই হবে? এটা কি এভাবেই চলবে। এই অসংগতি কি কখনাে দূর হবে? (অদৃশ্য মানব)


উত্তর : এই সমাজে হিজড়া নতুন সম্প্রদায় নয়। বহু বছর আগে থেকেই হিজড়া জনগােষ্ঠী ছিল— যারা ছিল প্রচণ্ড অবহেলিত এবং এখনও তাই আছে। হয়তাে একদিন আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। তবে হ্যা, হয়তাে আমার সাথে আর এধরনের ব্যবহার কোনােদিনও হবে না। আমাকে হয়তাে আর আপনাদের কুরুচিপূর্ণ কথা কিংবা ব্যবহার মেনে নিতে হবে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post