আমার ডাক নাম হকিং। পুরাে নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। আমি লিখি স্টিফেন ডব্লিউ হকিং। আমার পদবি স্টিফেন। আর গােষ্ঠী উইলিয়াম। আমার জন্ম ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে। তারিখটা গ্যালিলিও'র মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছর পরের ঘটনা। তবে আমার ধারণা, সে দিন আরাে প্রায় দু লক্ষ শিশু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমি জানি না তাদের ভেতরে আর কেউ আমার মতাে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আকৃষ্ট হয়েছিলাে কি-না। আমার বাবা-মা যদিও লন্ডনে থাকতেন, তবুও আমার জন্ম হয়েছিলাে অক্সফোর্ডে। তার কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জন্মানাের পক্ষে অক্সফোর্ড জায়গাটা তুলনামূলকভাবে ভালাে ছিলাে। জার্মানদের সাথে একটা চুক্তি ছিলাে যে, তারা অক্সফোর্ড কিংবা কেব্রিজে বােমা বর্ষণ করবে না, তার বদলে ব্রিটিশরাও হাইডেলবার্গ (Heidelberg) এবং গটিংগে (Gottingern)-এ কোনাে ধরনের বােমা বর্ষণ করবে না। তবে এটা খুব দুঃখের কথা, অনেকটা সুসভ্য এ ব্যবস্থা অন্যান্য শহরগুলােতে বিস্তৃত করা যায় নি। তাই যুদ্ধ এখানে অনেক ধ্বংস ডেকে আনে।
স্টিফেন হকিং এর জন্ম ও শৈশব - প্রথম পর্ব |
আমার পিতা খুব পরিশ্রমী এবং ভালাে লােক ছিলেন। আর তিনি ছিলেন ইয়র্কশায়ারের (Yorkshier) অধিবাসী। তার পিতামহ অর্থাৎ আমার প্রপিতামহ ছিলেন একজন গুণসম্পন্ন কৃষিজীবী। তিনি অনেকগুলাে ক্ষেত-খামার কিনেছিলেন। এ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফসলের বাজারে যে সঙ্কট উপস্থিত হয়, তার ফলে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান। এ জন্যে আমার বাবার বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়ে। তবুও তারা বাবাকে শিক্ষার জন্যে পৃথিবীখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ডে পাঠান। বাবা সেখানে চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ নেন।
তারপর তিনি ট্রপিক্যাল্ ডিজিজে (Tropical disease) গ্রীষ্মপ্রধান দেশের ব্যাধি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব আফ্রিকায় যান। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্থলপথে আফ্রিকা পেরিয়ে একটা জাহাজ ধরে ইংল্যান্ডে পৌঁছান। সেখানে তিনি স্বেচ্ছায় সামরিক কর্মে যােগ দিতে চান। কিন্তু তাকে বলা হলাে যে, তার চিকিৎসাবিদ্যায় গবেষণা আরাে বেশি মূল্যবান। কেননা তার মেধা ছিলাে অনেক। তারা সেটাকে কাজে লাগাতে চাইলেন।
আজকে পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব আমার মা। আমার এই মা ছিলেন একজন পারিবারিক চিকিৎসকের সাতটি সন্তানের ভেতরে দ্বিতীয়া। তার জন্ম হয়েছিলাে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগাে (Glasgow) শহরে। তার যখন বারাে বছর বয়স তখন তাদের পরিবার দক্ষিণে ডেভন্ (Devon)-এ চলে আসেন। আমার বাবার পরিবারের মতাে তাদের পরিবার অতােটা অবস্থা সম্পন্ন ছিলাে না, তবুও তারা আমার মা-কে শিক্ষার জন্যে অক্সফোর্ডে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। তারপর তিনি অনেক রকম কাজ-কর্ম করেছেন। তার ভেতরে একটি ছিলাে ট্যাক্স ইন্সপেক্টরের (Tax Inspector) চাকরি। এ কাজটা তার দারুন অপছন্দ ছিলাে। সেই চাকরি ছেড়ে তিনি সেক্রেটারির কাজ নেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে এ ভাবে তার সাথে আমার বাবার দেখা হয়। তখন দু জনই কর্মমুখর, দায়িত্ববান, পরিশ্রমী এবং নিষ্ঠাবান হিসেবে খ্যাত।
খুব ছােট বেলার কথা। সে সময় আমরা থাকতাম উত্তর লন্ডনের হাইগেট (Highgate)-এ। আমার বােন মেরির জন্ম হয় আমার জন্মের আঠারাে মাস পর । আমি শুনেছি, আমার বােনের জন্ম আমার একটুও পছন্দ হয় নি। আমাদের দু জনের বয়সের পার্থক্য ছিলাে খুব অল্প, সে জন্যে সমস্ত শৈশব জুড়ে আমাদের দু জনের অনেক বিষয়ে দ্বন্দ্ব ছিলাে। বড় হওয়ার পর কিন্তু এ দ্বন্দ্ব আর থাকে নি। তার কারণ আমরা ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছি। বােন একজন নামকরা ডাক্তার হলাে। ফলে আমার বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার ছােট বােন ফিলিপা (Philippa)-র যখন জন্ম হয়, তখন আমার বয়স প্রায় পাঁচ ।
ব্যাপারটা কী ঘটছে সেটা তখন বেশ করে বুঝতে পারতাম। আমার মনে পড়ে আমি তার আগমনের প্রতীক্ষা করেছি। ভেবেছি, আমরা তিনজন এক সাথে খেলতে পারবাে। সে ছিলাে খুব ভাবপ্রবণ আর অনুভূতিপ্রবণ। আমি সব সময়ই তার বিচার-বুদ্ধি এবং মতামতের মূল্য দিয়েছি। আমার ভাই এড়ওয়ার্ডের জন্ম হয়েছে তার অনেক পরে। সুতরাং আমার শৈশবের সাথে তার সম্পর্ক ছিলাে খুবই কম। পরিবারের অন্য তিন শিশুর সাথে তার বেশ পার্থক্য ছিলাে। বৌদ্ধিক (Intellectual) এবং শিক্ষাজগতের সাথে (Academic) তার সম্পর্ক একেবারেই ছিলাে না। হয়তাে এটা আমাদের পক্ষে ভালােই হয়েছে। শিশু হিসেবে ওকে সামলানাে ছিলাে বেশ কঠিন। কিন্তু ওকে ভালাে না বেসে পার যেতাে না। ওর চাল-চলন, কথা-বার্তা, লেন-দেন আমাদের খুব ভালাে লাগতাে।
আরও পড়ুন,
গল্পটা মিথ্যে নয় - সকল পর্ব
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
এ বিষয়ে অনেক স্মৃতির কথা আমি বলতে পারি। তবে প্রথম যে স্মৃতি আমার মনে আছে সেটা হলাে হাইগেটের বায়রন্ হাউসে (Byron House) নার্সারিতে দাঁড়িয়ে কেঁদে বুক ফাটিয়ে দেওয়া। আমার চারদিকে বাচ্চারা খেলা করছিলাে। আমার মনে হয়েছিলাে খেলনাগুলাে অত্যন্ত সুন্দর। আমারও খেলতে ইচ্ছে করছিলাে, কিন্তু আমার বয়স ছিলাে মােটে আড়াই বছর। আর এই প্রথম আমাকে একেবারে অচেনা-অজানা বড় বড় লােকেদের ভেতরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল
আমার মনে হয় বাবা-মা আমার ব্যাপারে দেখে একটু অবাকই হয়েছিলেন। কেননা আমি ছিলাম তাদের প্রথম সন্তান। তাদের আমার প্রতি অনেক টান ছিলাে আর ভালােবাসা ছিলাে অফুরন্ত। তারা শিশুদের বিকাশ সম্পর্কে পড়াশােনা করেছিলেন, সে সব বইয়ে লেখা ছিলাে দু বছর বয়স থেকেই শিশুদের সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। কিন্তু সেই ভয়াবহ সকালের পর থেকে ওরা আমার স্কুল ছাড়িয়ে দিলেন। আবার আমাকে বায়রন হাউসে পাঠিয়েছিলেন দেড় বছর পর। এ ঘটনা আমার মাঝে খুব রেখাপাত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধের ঠিক পরপর হাইগেট অঞ্চলে বিজ্ঞানজগতের অনেকেই থাকতেন। অন্য কোনাে দেশ হলে তাদের বুদ্ধিজীবী' বলা হতাে। কিন্তু ইংরেজরা আলাদা চিন্তার লােক। তারা নিজেদের ভেতরে বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্ব কখনাে স্বীকার করে নি। এখানকার সমস্ত বাবা-মা-ই তাদের ছেলে-মেয়েদের বায়রন্ হাউসে পাঠাতেন। সে সময়কার মান অনুসারে স্কুলটা ছিলাে খুবই প্রগতিশীল। আমার বেশ মনে পড়ে বাবা-মা’র কাছে আমি নালিশ করতাম যে, স্কুলে আমাকে কিছু শেখায় না।
তখনকার প্রচলিত পদ্ধতি ছিলাে অত্যধিক জোর করে ছাত্রদের শেখানাে। এ পদ্ধতিতে তারা বিশ্বাস করতেন না। তার বদলে আশা করা হতাে, ছাত্ররা বুঝতে পারবে না যে, তারা শিখছে কিন্তু তারা পড়তে শিখে যাবে একেবারে নিজেদের অজান্তে। শেষ পর্যন্ত আমি পড়া শিখেছিলাম এবং সেটা আট বছর বয়সে। বয়সটা একটু বেশিই হয়েছিলাে। আমার বােন ফিলিপপাকে শেখানাে হয়েছিলাে প্রচলিত পদ্ধতিতে। সে চার বছর বয়সেই অনেক কিছু পড়তে পারতাে। নিঃসন্দেহে তার বুদ্ধি ছিলাে আমার চেয়ে বেশি। তার সব কিছু আমাকে মুগ্ধ করতাে।
Post a Comment