জেক ব্রোনােওয়াস্কির (Jacob Bronowski) টি.ভি. সিরিজ—দি এসেন্ট অভ ম্যান্ (The Ascent of Man—মানুষের উত্থান) আমার খুবই ভালাে লেগেছিলাে। (এ রকম একটা লিঙ্গ প্রাধান্যমূলক নাম আজকাল আর কেউ সহ্য করবে না। এ থেকে মাত্র পনেরাে হাজার বছর আগেকার আদিম অবস্থা থেকে মানবজাতির আধুনিক অবস্থার উত্তরণের কৃতিত্ব সম্পর্কে একটা ভাবানুভূতি লাভ করা যায়। মহাবিশ্বকে যে সমস্ত বিধি শাসন করে সেগুলােকে সম্পূর্ণ করে জানার পথে আমাদের অগ্রগতি সম্পর্কে ঐ রকমই একটা ভাবানুভূতি আমি বহন করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
মহাবিশ্বের ক্রিয়া-প্রণালী সম্পর্কে প্রায় সবাই জানতে ইচও আগ্রহী এ বিষয়ে আমি পুরােপুরি নিশ্চিত ছিলাম । কিন্তু বেশি ভাগ লােকই গাণিতিক সমীকরণ বুঝতে পারেন না— তা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমিও সমীকরণগুলাের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করি না। মূলত এর কারণ আমার পক্ষে সমীকরণ লেখা শক্ত। কিন্তু আসল কারণ হলাে সমীকরণ সম্পর্কে আমার বাবােধ (Intkuitive Feeling) ছিলাে না। তার পরিবর্তে আমি চিন্তা করি চিত্রের বাৰিধিতে। এ বইটিতে আমার উদ্দেশ্য ছিলাে এ সমস্ত মানচিত্র কয়েকটি পিরচিতি উপমা এবং চিত্রের সাহায্যে ভাষায় প্রকাশ করা আমার আশা ছিলাে গত পঁচিশ বছরে পদার্থবিদ্যার যে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে সে সম্পর্কে উত্তেজনা এবং কৃতিত্ববােধের অংশীদার সবাই হতে পারবে ।
{ গণিতকে এড়িয়ে গেলেও কিছু কিছু চিন্তাধারা এরিচিত এবং ব্যাখ্যা করা কঠিন । এটাও একটা সমস্যা সৃষ্টি করলাে। এগুলাে কি আমি ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার ঝুঁকি নিবাে, না কি অসুবিধাগুলাে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাবাে? যেমন : বিভিন্ন গতিতে চলমান দু জন পর্যবেক্ষকের পক্ষে দুটি ঘটনার অন্তর্তীকালের মান ভিন্ন হবে— তথ। চিত্রটির জন্যে অপরিহার্য নয়। সে জন্যে আমি ভেবেছিলাম বেশি গভীরে না গিয়ে এলাে কেবল উল্লেখ করতে পারি। আমি যা বােয়াতে ই তার জন্য কতগুলাে কঠিন না হিলাে মূলগত। বিশেষ করে এ রকম দুটি কনা হলাে যে তাকে এম ইতি উচিত বলে ভেবেছিলাম ! একটা ছিলাে তং"কহিত ইতিহলাম একটু যােগফল।
এ চিত্তনটি হলাে, মহাবিশ্বের কেবল একটা ইতিহই নেই, ইং ১১ই মহাবিয়ে সম্ভাব্য সমস্ত ইতিহাসের সমাহার এবং এ সমস্ত ইতিহনই মন যে তব (২ নং বই হােক না কেন)। ইতিহাসের যােগফল কংটার গতিক ত ত হল আর একটা চিন্তন দরকার। আর সেটা হলাে 'কনিক কাল' (1177.s: 1:1) বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এখন আমি বুৰত গরম এ এত কঠিন কনা ব্যাখ্যা করার জন্যে আমার আরাে বেশি পরিশ্রম করা উচিত হলাে এক বিশেষ করে প্রযােজ্য কাল্পনিক কাল সম্পর্কে। মনে হয় বইয়ের ভেতরের এ ব্যাপারটাই অধিকাংশ পাঠকের অসুবিধার কারণ হয়েছে। কাল্পনিক কাল নির্ভুলভাবে বুঝবার সত্যিই কোনাে প্রয়ােজন নেই। এই কাল, আমরা যাকে বাস্তব কাল' বলি তার চেয়ে পৃথক—এটা জানাই যথেষ্ট। তার চেয়ে আর বেশি নয়। বইটা যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন একজন বৈজ্ঞানিক নেচার' (Nature) পত্রিকায় সমালােচনার জন্যে আগাম পাঠানাে এ বই একৎনা পান। বইটি পড়ে তিনি একবারে আঁতকে উঠলেন। বইটি ছিলাে ভুলে ভরা। তা ছাড়া আলােকচিত্র এবং অন্য ছবিগুলাের লেবেলেও (Label) গােলমাল ছিলাে। তিনি ব্যান্টামের সাথে কথা বললেন। তারাও একই রকম আঁতকে উঠলেন।
তারা সে দিনই সমস্ত ছাপা বই ফিরিয়ে এনে এগুলাে একেবারে নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা তিন সপ্তাহ অত্যন্ত পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ বইটা সংশােধন করলেন, তা হ'ভা বার বার মিলিয়ে দেখলেন ! বইটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিলাে এই মাসে—কাশিত হয়েছিলাে ঠিক দিনেই। এর ভেতরে টাইম (The Time) পত্রিকায় আমার সম্পর্কে একটা লেখা প্রকাশিত হলাে। তবুও বইটার চাহিদা দেখে সম্পাদকরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকাতে বইটির সপ্তদশ মুদ্রণ চলেছে আর ব্রিটেনে চলেছে দশম শ ।
এতাে লোেক বইটি কিনলেন কেন? আমি যে বস্তুনিষ্ঠ সে সম্পর্কে নিমিত্ত হওয়া আমার পক্ষে শক্ত। সে জন্যে আমার মনে হয়, অন্য লােকে যা বলেছিলাে সেই অনুসারে চলবাে । আমি দেখেছি অধিকাংশ সমালােচনাই আমার পক্ষে হলেও তারা বিশেষ কোনাে আলােকপাত করে নি। তারা সবাই একটা ফর্মুলা মেনে চলতে চেয়েছে। তা হলাে স্টিফেন হকিং-এর লু গেরিগ-এর (Lou Gehrig) ব্যাধি আছে (আমেরিকার সমালােচনাগুলােতে) কিংবা মােটর নিউরন ডিজিস আছে (ব্রিটিশ সমালােচনাগুলােতে)। তিনি একটা হুইল চেয়ারে আটকে থাকেন, কথা বলতে পারেন না এবং এক্স সংখ্যক আঙুল নাড়াতে পারেন (এ ক্ষেত্রে মনে হয় X-এর মান এক থেকে তিন-এর ভেতরে ঘােরাফেরা করে। সংখ্যাটা নির্ভর করে সমালােচক আমার সম্পর্কে কোন ভুল প্রবন্ধটা পড়েছেন তার উপরে)। এসেছি তবুও তিনি বৃহত্তম প্রশ্নের উপরে এ বইটি লিখেছেন যে, কোথেকে আমরা আর কোথায় আমরা চলেছি?' হকিং যে প্রস্তাব করেছেন সেটা হলাে মহাবিশ্ব কেউ সৃষ্টি করে নি এবং ধ্বংসও হয় না; এটা কেবল রয়েছে। হকিং কাল্পনিক কালের কল্পনা উপস্থিত করেছেন। সেটা বুঝতে আমার (সমালােচক) বেশ কষ্ট হয় । তবুও হকিং-এর বক্তব্য যদি সঠিক হয় এবং আমরা যদি একটা সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব খুঁজে পাই তাহলে আমরা সত্যিই সৃষ্টিকর্তার মনটা জানতে পারবাে (প্রুফ দেখার সময় আমি বই-এর শেষ বাক্যটি প্রায় কেটেই দিয়েছিলাম। সে বাক্যটি হলাে—আমি সৃষ্টিকর্তার মনটা জানতে পারবাে। এটা যদি করতাম তাহলে বিক্রিটা অর্ধেক হয়ে যেতাে)।
প্রবন্ধ দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট' (The Independent) নামে লন্ডনের একটা পত্রিকায় একটা বেরিয়েছিলাে সেটা (আমার মনে হয়েছিলাে) অনেক বেশি অনুভব গুণসম্পন্ন। এ প্রবন্ধে লেখা হয়েছিলাে যে, কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মতাে একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক বইও একটা ধর্মসম্প্রদায়ের পুস্তক হয়ে উঠতে পারে। আমার স্ত্রী আতঙ্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু ‘জে এবং মােটর সাইকেল রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়ার মতাে একটা বই-এর সাথে আমার বই-এর তুলনা হতে পারে এই ভেবে আমি খুব খুশি হয়ে উঠেছিলাম । জেনের মতাে আমারও আশা, বিরাট বৌদ্ধিক এবং দার্শনিক প্রশ্নগুলাে থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনাে প্রয়ােজন যে মানুষের নেই, সেই বােধ যেনাে তাদের হয় । সে আশায় আমি মগ্ন ছিলাম ।
নিঃসন্দেহে অথর্ব হওয়া সত্ত্বেও আমি কীভাবে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হতে পেরেছি সেই মানবিক আকর্ষণােদ্দীপক কাহিনী সাহায্য করেছিলাে। কিন্তু যারা মানবিক আকর্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ বইটি কিনেছিলেন তারা হয়তাে হতাশ হয়েছেন। তার কারণ, আমার অবস্থা সম্পর্কে বইটিতে গােটা দুয়েক উল্লেখ মাত্র আছে। বইটির উদ্দেশ্য ছিলাে মহাবিশ্বের ইতিহাস লেখা, আমার ইতিহাস নয়।
তা সত্ত্বেও এ দোষারােপ এড়ানাে যায় নি যে, ব্যান্টাম নির্লজ্জভাবে আমার অসুস্থতাকে ব্যবহার করেছে এবং প্রচ্ছদপটে আমার ছবিটা ব্যবহার করতে দিয়ে আমিও তাদের সাথে সহযােগিতা করেছি। আসলে ছবিটা ব্যবহার করতে দিয়ে আমিও তাদের সহায়তার হাত বাড়ালাম। মূলত চুক্তি অনুসারে প্রচ্ছদের উপরে আমার কোনাে অধিকার তখন ছিলাে না। তবে আমি ব্যান্টামকে বুঝাতে পেরেছিলাম যে, আমেরিকান সংস্করণে বিশ্রী এবং আগেকার ফটো ব্যবহার না করে ব্রিটিশ সংস্করণের একটা ভালাে ফটো ব্যবহার করা। হােক। ব্যান্টাম আমেরিকান প্রচ্ছদ পরিবর্তন করবেন না। তার কারণ, আমেরিকান জনসাধারণ এখন বইয়ের প্রচ্ছদটাকে আমার সাথে অভিন্ন মনে করে। বিষয়টি ভাবলে আমি এখনও আনন্দ অনুভব করি।
অনেকে এ কথাও বলেছেন যে, লােকে বইটি কেনে। তার কারণ হলাে তারা বইটির সমালােচনা পড়েছেন কিংবা বইটির উল্লেখ সর্বাধিক বিক্রীত পুস্তকের তালিকায় রয়েছে। কিন্তু বইটি তারা পড়েন নি। তারা বইটি তাদের বুক কেসে কিংবা টেবিলে সাজিয়ে রাখেন। ফলে বইটি বুঝবার মতাে পরিশ্রম না করে বইটির মালিকানার গৌরব অনুভব করেন। এ রকম যে ঘটে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তবে বাইবেল কিংবা সেক্সপীয়রের মতাে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের যে রকম অবস্থা হয় তার চেয়ে মন্দ কিছু হয় বলে আমি জানি না। অন্যদিকে আবার আমি জানি, অন্তত কিছু লােক বইটি পড়েছে। তার অনেকে বিস্তৃত মন্তব্য করেন। তাতে বােঝা যায় সবটা না বুঝলেও বইটি তারা পড়েছেন। এ ভাবনায়ও আমি আনন্দ পাই।
অপরিচিত অনেকে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলেন যে, বইটি তাদের কতাে ভালাে লেগেছে। অবশ্য অন্য লেখকদের তুলনায় আমাকে অনেক সহজে চেনা যায় আর আমার বিশেষত্বও বেশি। আমি বিখ্যাত হয়তাে নই, কিন্তু জনসাধারণের কাছ থেকে আমি যতাে অভিনন্দন পাই (আমার নয় বছরের ছেলে তাতে খুব সঙ্কোচ বােধ করে তা থেকে মনে হয় যারা কেনেন তাদের ভেতর অন্তত কিছু সংখ্যক লােক বইটি পড়েনও। লােকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, এর পরে আমি কী করবাে? আমি বুঝতে পারি কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস' (A Brief History of Time)-এর পরিণাম কী পরিণতি লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেটার নাম কী দিবাে? কালের দীর্ঘতর ইতিহাস? (A Briefer History of Time), কালের সমাপ্তি পথ?' কিংবা কালের সন্তান আমার এজেন্টরা বলছেন, আমার জীবনীর উপরে একটা চলচ্চিত্র করার অনুমতি দিতে। কিন্তু আমি যদি অভিনেতাদের দিয়ে নিজের চরিত্র চিত্রণ করি তাহলে আমার কিংবা আমার পরিবারে কোনাে আত্মসম্মান অবশিষ্ট থাকে না। স্বল্পতর হলেও কাউকে যদি আমার জীবনী লিখতে দিই তাহলেও ব্যাপারটা এক রকম হবে।
আরও পড়ুন,
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
অবশ্য কেউ যদি স্বাধীনভাবে আমার জীবনী লেখেন তাহলে আমি বাধা দিতে পারি —অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি অপমানজনক কিছু না লিখছেন। কিন্তু আমি তাদের এই বলে বাঁধা দিই যে, আমি নিজের আত্মজীবনী লেখার কথা ভাবছি। হয়তাে আমি লিখবােও। কিন্তু আমার কোনাে তাড়া নেই। বিজ্ঞানে আমার অনেক কাজ, প্রথমে আমি সে কাজ করতে চাই। আমি অনেক অনেক দূর যেতে চাই, আর আমার ভাবনাকেও সেখানে নিয়ে যেতে আমি বদ্ধ পরিকর। আর আমি সফল হতে চাই।
Post a Comment