সে জন্যে আমার মত হলাে—পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব পর্যবেক্ষণফলের বর্ণনা দেওয়ার জন্যে একটা গাণিতিক প্রতিরূপ মাত্র। অনেকে এ জন্যে আমাকে স্বল্পবুদ্ধি কিংবা অর্বাচীন বলে থাকেন। একটা তত্ত্ব যদি গঠনে সুন্দর হয়, যদি বহু পর্যবেক্ষণফল ব্যাখ্যা করতে পারে এবং নতুন নতুন পর্যবেক্ষণফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে তাহলে আমরা বলি যে, তত্ত্বটা উত্তম (Best)। এর বাইরে তত্ত্বটা বাস্তবানুগ কি-না সে প্রশ্ন করার অর্থ হয় না ।
তার কারণ তত্ত্বনিরপেক্ষ বাস্তবতা কি আমরা জানি না। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসম্পর্কীয় এ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আমাকে যন্ত্রবাদী’ কিংবা দৃষ্টবাদী’ (Positivist) বলা হতে পারে, এ কথা আমি আগেই উপস্থাপন করেছি। আমাকে দু রকমই বলা হয়েছে। যিনি আমাকে দৃষ্টবাদী’ বলেছিলেন, তিনি তার সাথে এ কথাও যােগ করেছিলেন যে, দৃষ্ট আজকাল অচল, এ কথা সবার জানা। কলঙ্ক আরােপ করে যুক্তি খণ্ডন করার এটা আরেকটা উদাহরণ।
ব্যাপারটা সেকেলে হতে পারে। কারণ এটা ছিলাে অতীতের বৌদ্ধিক খেয়াল। কিন্তু যারা মহাবিশ্বের বিবরণ দান করার জন্য নতুন পদ্ধতি খুঁজছেন তাদের পক্ষে আমি দৃষ্টবাদের যে বিবরণ দিয়েছি সেটা গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাস্তবতার নামে আপিল করে কোনাে লাভ নেই। কারণ বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের কোনাে অন্য নিরপেক্ষ প্রতিরূপ নেই। আমার মতে, একটা অন্য নিরপেক্ষ বাস্তবতা সম্পর্কে অব্যক্ত বিশ্বাসই বিজ্ঞানের দর্শনের পক্ষে কণাবাদী বলবিদ্যা এবং অনিশ্চয়তাবাদ নিয়েই অসুবিধার কারণ।
শ্রয়েডিংগার-এর বিড়াল নামে একটা বিড়ালকে পুরে দেওয়া হলাে। বিড়ালটার দিকে একটা বন্দুক তাক করা আছে। যদি কোনাে তেজস্ক্রিয় কেন্দ্রক (Radio Active Nucleus) ক্ষয়প্রাপ্ত হয় (Decays) হাতলে বন্দুকটা থেকে গুলি বের হবে। এ রকম হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ । (আজকালকার দিনে এ রকম প্রস্তাব করতে কেউ সাহস করবেন না। এমন কি শুদ্ধ-চিন্তন পরীক্ষার উপরও নয়। কিন্তু শ্রয়েডিংগারের সময় জন্তুদের মুক্তির কথা কেউ শােনেন নি।) বাক্সটা কেউ খুললে বিড়ালটাকে হয় জীবিত নয় মৃত দেখবেন।
কিন্তু এ বাক্সটি খােলার আগে বিড়ালটার কণাবাদী অবস্থান হবে মৃত বিড়ালের অবস্থা এবং জীবিত বিড়ালের অবস্থার একটা মিশ্রণ । এটা অবশ্যই ঘটবে। অনেক বিজ্ঞানের দার্শনিকের এ ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কষ্ট। তাদের বক্তব্য হলাে, বিড়ালটা অর্ধেক গুলি খাওয়া এবং অর্ধেক গুলি না খাওয়া হতে পারে না। ঠিক যেমন একজন মহিলা অর্ধেক গর্ভবতী হতে পারেন না। তাদের অসুবিধা হলাে বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের ধারণার ভেতরে নিহিত রয়েছে চিরায়ত চিন্তাধারা। সে চিন্তনে একটা বস্তুপিণ্ডের একটাই নির্দিষ্ট নিশ্চিত ইতিহাস রয়েছে। কণাবাদী বলবিদ্যার মূল বক্তব্যই হলাে বাস্তবতা সম্পর্কে তার দৃষ্টি ঠিক অন্য রকম।
এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে একটা বস্তুপিণ্ডের একটা মাত্র ইতিহাসই নেই, আছে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার ইতিহাস। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ একটা মাত্র ইতিহাস থাকার সম্ভাবনা এবং সামান্য পৃথক আর একটা ইতিহাস থাকার সম্ভাবনা পরস্পরকে বাতিল করে দেবে। কিন্তু কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ইতিহাস থাকার সম্ভাবনা পরস্পরের শক্তি বৃদ্ধি করে। একটা বস্তুপিণ্ডের ইতিহাসে আমরা পর্যবেক্ষণ করি শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে (Reinforced) এ রকম আরেকটা ইতিহাস। শ্রয়েডিংগারের বিড়ালের ক্ষেত্রে রয়েছে দুটি ইতিহাস—যাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। একটা ইতিহাসে বিড়ালটিকে গুলি করা হয়েছে, অন্যটিতে সে বেঁচে আছে। কণাবাদী বলবিদ্যার দুটি সম্ভাবনার অস্তিত্ব একত্র থাকতে পারে, কিন্তু কোনাে কোনাে দার্শনিক প্যাচে পড়ে যান। কারণ তাদের অন্তর্নিহিত অনুমান হলাে বিড়ালের একটা ইতিহাসই থাকতে পারে।
আমাদের পদার্থবিদ্যা সম্পর্কীয় তত্ত্বের বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের কল্পনা নির্ধারণ করার আর একটা উদাহরণ কালের ধর্ম। কালের প্রবাহ অন্য কোনাে ঘটনা নিরপেক্ষ এবং চিরন্তন—এ তথ্যকে আগে ভাবা হতাে স্বতঃপ্রতীয়মান। কিন্তু অপেক্ষাবাদ স্থান এবং কালকে সংযুক্ত করে ঘােষণা করলাে মহাবিশ্বের পদার্থ এবং শক্তি, স্থান এবং কাল দুটিকেই বিকৃত করে দিতে পারে। কালের ধর্ম সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি আগে ছিলাে, এ ধর্ম মহাবিশ্ব নিরপেক্ষ কিন্তু সে ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে।
এখন মনে করা হয় মহাবিশ্বই কালের ধর্মের রূপ দান করে। তখন এ রকম চিন্তন সম্ভব হয় যে, অতীতে একটা বিশেষ বিন্দুর পূর্বে কালের সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। অতীতে গমন করলে এমন একটা অনতিক্রমনীয় বাঁধা অর্থাৎ অনন্যতার (Singularity) মুখােমুখি হওয়ার সম্ভাবনা। সে বাধা অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাই যদি হয় তাহলে বৃহৎ বিস্ফোরণ (Big Bang) কী করে হলাে কিংবা সে বিস্ফোরণ কে ঘটালাে সে প্রশ্ন করার কোনাে অর্থ হয় না। |
সৃষ্টি কিংবা কারণ সম্পর্কে আলােচনায় এ অনুমান নিহিত থাকে যে, বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতার আগেও একটা কালের অস্তিত্ব ছিলাে। পঁচিশ বছর হলাে আমরা জানি যে, আল্বার্ট আইনস্টাইনের ব্যাপক অপরুন অনুৰে নে হাজার কোটি বছর আগে একটা অন্যতায় কাল শুরু হয়েছিলাে। কিছু নশনকরা এখনাে এ চিকনের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেন নি। এখনাে তাদের চিন্তা কণাবানী বলবিদ্যায় তিনি নিয়ে। সে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে পয়ষট্টি বয় আসে। পদার্থবিদ্যার সীমান্ত যে এগিয়ে চলছে এটা তারা বােঝন না। হতে পারে তারা বুঝতে চান না। *** চত ১০ : বিং এবং সময় ।
আরাে মন্দ হলাে কাল্পনিক কালের গাণিতিক করুন। এ কক্ষনে আমি আর জিম্ হার্ট (Jim Hartle) প্রস্তাব করেছিলাম যে, মহাবিশ্বের হয়তাে কোনাে রু কিংবা শেষ নেই।' কাল্পনিক কাল সম্পর্কে বলার জন্যে একজন বিজ্ঞানের দার্শনিক আমাকে বর্বরভাবে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'কাল্পনিক কালের মতাে একটা গাণিতিক চাতুরির বাস্তব মহাবিশ্বের সাথে কি সম্পর্ক থাকতে পারে? আমার মনে হয় গাণিতিক প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত কথা—বাস্তব আর কাল্পনিকের সাথে সাধারণ দৈনন্দিন ভাষায় ব্যবহৃত বাস্তব আর কাল্পনিক’ শব্দের অর্থের তারা গােলমাল করে ফেলেছেন।
আমার বক্তব্য বিষয়ের এটা একটা উদাহরণ। তত্ত্ব কিংবা ব্যাখ্যা করার মতাে কোনাে প্রতিরূপ (Model) না থাকলে আমরা কী করে জানবাে কোটা বাস্তব? মহাবিশ্বকে বুঝবার সমস্যা বােঝানাের চেষ্টায় আমি অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যা থেকে উদাহরণ ব্যবহার করেছি। আপনি যদি অপেক্ষবাদ কিংবা কণাবাদী বলবিদ্যা না বুঝতে পারেন তাহলেও কিছু আসে যায় না। এমন কি তত্ত্বগুলাে ভুল হলেও কিছু যায় আসে না। আশা করি আমি দেখাতে পেরেছি—তত্ত্বকে একটা প্রতিরূপ হিসেবে ব্যবহার করা যায় এ রকম কোনাে দৃষ্টবাদী (Positivist) পদ্ধতি, অন্ততপক্ষে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদের পক্ষে মহাবিশ্বকে বুঝবার একমাত্র উপায় ।
আরও পড়ুন,
সকল গল্প
মানুষ হতে পারিনি - সকল পর্ব
না পাওয়ার গল্প - সকল পর্ব
পথ শিশু শাওন - সকল পর্ব
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় - সকল পর্ব
একজন হকার - সকল পর্ব
Fact Mohi
সকল চাকরির খবর
অফার
স্বপ্ন থেকে স্বপ্না - সকল পর্ব
আমরা সুপার হিরাে নয় - সকল পর্ব
হাসমত মিয়ার জাতীয় পেশা - সকল পর্ব
Shuvo Academy
Shuvo Academy YT
আমি আশা করি, মহাবিশ্বের সব কিছুর বিবরণ দেওয়া যায় এ রকম একটা সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিরূপ আমরা আবিষ্কার করতে পারবাে। তা যদি আমরা করি তাহলে সেটা হবে মানবজাতির একটা সত্যিকারের জয়। মানবজাতি ভবিষ্যতের আশার আলাে দেখতে পাবে।
Post a Comment