F স্টিফেন হকিংয়ের অবস্থান - প্রথম পর্ব

আমার মাথায় ভাবনা অনেক। আমার প্রবন্ধের বিষয় বেশ কয়েকটি । তবে এ প্রবন্ধটি আমি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি না সে বিষয়ে নয়। তার বদলে আমি আলােচনা করবাে মহাবিশ্বকে কী করে বােঝা যায়। সে বিষয়ে আমার অগ্রসর হওয়ার পদ্ধতি মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের (Grand Unified Theory) অর্থই বা কী, অবস্থানই বা কোথায়? মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বকে বলা যায় সর্ববিষয়ব্যাপী একটা তত্ত্ব। এ ক্ষেত্রে একটা সত্যিকারের সমস্যা রয়েছে। এ জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা এবং তর্ক করা উচিত দার্শনিকদের। 

 

স্টিফেন হকিংয়ের অবস্থান - প্রথম পর্ব

 

কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার আধুনিক বিকাশ সম্পর্কে অবহিত থাকার মতাে যথেষ্ট গাণিতিক যােগ্যতা হয়তাে নেই।   একটা উপজাতি আছে তার নাম ‘বিজ্ঞানের দার্শনিক। তাদের শিক্ষার মান আর একটু ভালাে হওয়া উচিত। কিন্তু তাদের ভেতরে অনেকেই বিফলকাম পদার্থবিদ। তারা দেখলেন যে, নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তার বদলে তারা পদার্থবিদ্যা আর দর্শন নিয়ে লেখা আরম্ভ করলেন। অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যার মতাে এ শতাব্দীর প্রথম দিকে আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলাে নিয়ে তারা এখনাে তর্ক করে চলছেন। পদার্থবিদ্যার বর্তমান সীমান্তের সাথে তাদের কোনাে যােগাযােগ নেই।   

 

 

এ কথা সত্য যে, হয়তাে দার্শনিকদের সম্পর্কে আমি একটু রূঢ় । কিন্তু তারাও আমার সাথে খুব সহৃদয় ব্যবহার করেন নি। আমার পদ্ধতিকে বলা হয়েছে অতি সরল (Naive) এবং স্বল্পবুদ্ধির মনের একটি প্রকাশ মাত্র। আমাকে নানা বিশেষণ দেওয়া হয়েছে— সংজ্ঞাবাদী' (Nominalist), যন্ত্রবাদী' (Instrumentalist), ‘দৃষ্টবাদী’ (Positivist), বাস্তববাদী’ (Realist) এবং অন্য নানা রকমবাদী। পদ্ধতিটা হলাে, কলঙ্ক আরােপ করে একটা মতকে খণ্ডন করা । যদি আমার মতবাদের উপরে একটা মার্কা (Lebel) লাগিয়ে দিতে পারেন তাহলে ভুলটা কোথায় সেটা আর বলার প্রয়ােজন হয় না। ঐ সমস্ত মতবাদের মারাত্মক ভুলগুলাে নিশ্চিতভাবে সবারই জানা।   

 

 

তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় যারা সত্যিকারের প্রগতি সাধন করেন, পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের দার্শনিক এবং ঐতিহাসিকরা তাদের যে শ্রেণিতে ফেলেন, ঐ আবিষ্কারক বিজ্ঞানীরা কিন্তু সে সব শ্রেণির কথা ভাবেন না। আমি নিশ্চিত আইনস্টাইন, হাইসেনবার্গ এবং ডিরাক্ এরা কখনােই নিজেরা বস্তুবাদী কিংবা যন্ত্রবাদী—তা নিয়ে কখনাে মাথা ঘামান নি। তাদের চিন্তার বিষয় ছিলাে—তখনকার তত্ত্বগুলাে পরস্পরের সাথে খাপ খাচ্ছিলাে না। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় অগ্রগতির ক্ষেত্রে যৌক্তিক সঙ্গতির অনুসন্ধান সব সময়ই পরীক্ষামূলক ফলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব লাভ করেছে।    পর্যবেক্ষণফলের সাথে অমিল হওয়ার জন্যে অন্য দিক থেকে অতি সুন্দর, অতি চমৎকার অনেক তত্ত্ব পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু কেবল পরীক্ষালদ্ধ ফলের ভিত্তিতে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব প্রস্তাবিত হয়েছে এ রকম কোনাে ঘটনা আমার জানা নেই। সব সময় তত্ত্বই এসেছে প্রথম। সে তত্ত্বের প্রস্তাবনার অর্থ ছিলাে সুন্দর এবং সঙ্গতিপূর্ণ একটা প্রতিরূপ তৈরি করা। তত্ত্ব তারপর ভবিষ্যদ্বাণী করে।   পর্যবেক্ষণের সাহায্যে সে ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা পরীক্ষা করা যায়। পর্যবেক্ষণ ফলের সাথে যদি ভবিষ্যদ্বাণীর ঐক্য ঘটে তাহলেও তত্ত্বটা প্রমাণিত হয় না। কিন্তু তত্ত্বটি আরাে ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্যে বেঁচে থাকে। সে ভবিষ্যৎ বাণীগুলােও যাচাই করা হয় পর্যবেক্ষণফলের নিরিখে। পর্যবেক্ষণফল যদি ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে না মেলে তাহলে তত্ত্বটা পরিত্যাগ করা হয়।   

 

কিংবা বলা যায়, ঐ রকমই হওয়ার কথা। যে তত্ত্বের পেছনে অনেক সময় এবং শ্রম ব্যয় করা হয়েছে কার্যক্ষেত্রে মানুষ সে তত্ত্ব পরিত্যাগ করতে চায় না। পর্যবেক্ষণফলের নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন করে তারা সূচনা করে। তাতে না হলে তারা তত্ত্বের একটা সাময়িক পরিবর্তন করতে চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তত্ত্বটা হয়ে দাঁড়ায় একটা বিশ্রী নড়বড়ে প্রাসাদ। তারপর কেউ একটা নতুন তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। সে তত্ত্বে পর্যবেক্ষণফলের গােলমেলে ব্যাপারগুলাে সুন্দর এবং স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়।   

 

 

এর একটা উদাহরণ, ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের মিচেলসনু-মর্লি (Michelson-Morley) পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় দেখা গেলাে যে, আলাের উৎস কিংবা পর্যবেক্ষক যেভাবেই চলমান হােক না কেন আলাের দ্রুতি সবসময় একই থাকে। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হয়েছিলাে। কেউ যদি আলােকের উৎসের অভিমুখে গমন করতে থাকে তাহলে আলাে সে দিকে চলমান সে দিকে যে চলছে তার তুলনায় প্রথম লােকটির মনে হবে আলাের দ্রুতি বেশি। কিন্তু পরীক্ষায় দেখা গেলাে যে, দু জন পর্যবেক্ষকই মাপনে দেখবেন আলাের গতি নির্ভুলভাবে অভিন্ন।   

 

 

তার পরের আঠারাে বছর হেরিক লােরেঞ্জ (Hendric Lorentz) এবং জর্জ ফিজারাল্ড (George Fitzgerald) স্থান এবং কাল সম্পর্কে সবার গৃহীত সাধারণ ভিত্তিতে পরীক্ষাফলকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। তারা কতােগুলাে তদর্থক (Adhoc) স্বীকৃতি উপস্থিত করলেন। যেমন তারা প্রস্তাব করলেন বস্তুপিণ্ডগুলাে যখন অধিক দ্রুতিতে চলমান হয় তখন তাদের দৈর্ঘ্য হ্রস্বতর হয়ে যায়'—এই প্রস্তাব পদার্থবিদ্যার কাঠামােটাই কুশ্রী এবং গােলমেলে হয়ে দাঁড়ালাে।   

 

 

তারপর আলবার্ট আইনস্টাইন উপস্থিত করলেন অনেক বেশি আকর্ষণীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি। এতে বলা হলাে যে, কাল সম্পূর্ণ স্বনির্ভর এবং বিচ্ছিন্ন নয়, তার বদলে তিনি স্থানের সমন্বয়কারী একটা চার মাত্রিক বস্তু তৈরি করেন, তার নাম দিলেন স্থান-কাল’ (Space-Time)। আলবার্ট আইনস্টাইন তত্ত্বের দুটি অংশের সঙ্গতিপূর্ণ সমন্বয়ে যতােটা উৎসাহী ছিলেন, পরীক্ষার ফলগুলাে তাকে এ চিন্তাধারার ব্যাপারে ততােটা উৎসাহিত করে নি। দুটি অংশের একটা হলাে যে, বিধিগুলাে বৈদ্যুতিক এবং চুম্বকক্ষেত্রগুলাে শাসন করে’ এবং আরেকটা হলাে যে, ‘বিধিগুলাে বিভিন্ন বস্তুগুলাের গতি শাসন করে।   

 

 

 আমার মনে হয় না, ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে আলবার্ট আইনস্টাইন কিংবা আর কেউ অপেক্ষবাদ অতােটা সরল এবং সুন্দর—সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। এ তত্ত্ব স্থান-কাল সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারায় সম্পূর্ণ একটা বিপ্লব এনে দেয়। বিজ্ঞান দর্শনে বাস্তববাদী হওয়া কতােটা কঠিন, অপেক্ষবাদ আবিষ্কার তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। কারণ আমরা যাকে বাস্তব’ বলি সেটা নির্ভর করে কোন্ তত্ত্ব আমরা সমর্থন করি তার উপর।   আমি নিশ্চিত যে, লােরেঞ্জ আর ফিটজারা নিজেদের বাস্তববাদী’ মনে করতেন। তারা আলােকের দ্রুটি সম্পকীয় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাকে নিউটনের পরম (Absolute) কাল এবং পরম স্থানের বাগ্বিধিতে ব্যাখ্যা করেছেন। মনে হয়েছিলাে স্থান এবং কাল’ সম্পর্কে এ ধারণাগুলাে সাধারণ বুদ্ধি এবং বাস্তবতার সাথে খাপ খায়। তবুও আজকাল যারা অপেক্ষবাদে বিশ্বাস করেন (যদিও তারা জনতার অতি ক্ষুদ্র এবং সংখ্যালঘু অংশ হওয়ার ফলে আমি উদ্বিগ্ন হই) তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্য রকম। স্থান এবং কাল সম্পর্কেও মূলগত ধারণা সম্বন্ধে আধুনিক বােধ আমাদের জনসাধারণকে জানানাে।  

 

 আরও পড়ুন,


আমরা যাকে বাস্তব’ (Real) বলি সেটা যদি নির্ভর করে আমরা যাকে ‘তত্ত্ব’ (Theory) বলি তার উপরে, তাহলে আমরা বাস্তবতাকে কী করে দর্শনের ভিত্তি করবাে? আমি বলবাে যে, সামনে একটা মহাবিশ্ব রয়েছে এবং সেটা অপেক্ষা করছে তার সম্পর্কে অনুসন্ধান করার জন্যে এবং তাকে বােঝার জন্যে–এ অর্থে আমি একজন বাস্তববাদী । আত্মজ্ঞানবাদীদের (Soulipsist) মতাে সব বস্তুই আমাদের কল্পনার সৃষ্টি। আমার ধারণা এ রকম কল্পনা কেবল সময় নষ্ট করাই হয়। এ ভিত্তিতে কেউই কাজ করে না। মহাবিশ্বের বাস্তবতা কী, তত্ত্ব ছাড়া সেটা আমরা সহজ ও সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারি না।

Post a Comment

Previous Post Next Post